রবিবার, ৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঝুঁকি নিয়ে দলে দলে ইউরোপ যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

নৌকায় উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর শরণার্থীদের ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশির সংখ্যা। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি নৌকায় করে ইতালিতে গিয়ে পৌঁছেছেন।

এ সংখ্যা অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। তাদের বেশির ভাগই লিবিয়া থেকে নৌকায় গেছেন। অথচ গত বছরের প্রথম তিন মাসে মাত্র একজন বাংলাদেশি এই অবৈধ পথে ইতালি গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ দৈনিক ইনডিপেনডেন্টের   এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। শরণার্থীবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ যাওয়াদের মধ্যে বেশির ভাগই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেই ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশি গবেষকদের মতে, শুধু রোহিঙ্গারাই নন, অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার জন্য লিবিয়াকে রুট ধরে অনেক দালালই বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশিদের প্রলুব্ধ করছেন। ব্রিটিশ দৈনিকটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপে শরণার্থীদের রুট ও জনমিতির মানচিত্র বদলে গেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় গিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে নৌকায় করে ইতালি যাওয়ার সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানো বাংলাদেশির সংখ্যাধিক্যের পেছনে রোহিঙ্গারাও একটি কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে থাকা রাজনৈতিক কর্মীরাও এই সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছেন বলে তাদের ধারণা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শরণার্থীর ঢল সামলাতে কয়েক বছর আগে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তির পর আজিয়ান সাগরের রুট দিয়ে অনুপ্রবেশ কমে গেলে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালিতে পাড়ি জমানো বেড়ে যায়। সক্রিয় হয়ে ওঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার মানব পাচারকারীরাও। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকার অবৈধ পথটি বেশ বিপত্সংকুল। সেখানে নৌকাডুবিসহ নানা কারণে এ বছরই প্রায় ১ হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আইওএম কর্মকর্তা ফ্লাভিও দি গিয়াকোমো ব্রিটিশ দৈনিকটিকে বলেছেন, গত বছর মার্চ নাগাদ তিন মাসে ইতালিতে ঢোকা বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল মাত্র একজন। কিন্তু চলতি বছরের ওই সময়ে এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৩১ জনে। এ তথ্য শরণার্থীদের জাতীয়তার পরিবর্তনের বিষয়টি মেলে ধরে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের লিবিয়াবিষয়ক গবেষক হানান সালেহ বলেন, ‘আমার জানা মতে দুবাই থেকে ত্রিপোলির (লিবিয়ার রাজধানী) কোনো সরাসরি ফ্লাইট নেই। দুবাই থেকে তিউনিসিয়া হয়ে আসতে হয়।’ তবে ইতালিতে যেতে নৌকায় ওঠার আগে বাংলাদেশ থেকে দুবাই কিংবা তুরস্ক হয়ে লিবিয়ার মাটিতে নামা বিমানেই ‘চুক্তি’ হয়। এজন্য ১০ হাজার ডলারের বেশি অর্থ পাচারকারীদের দিতে হয়েছে বলে ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে উদ্ধার বাংলাদেশি কয়েকজন দাতব্য সংস্থা ও মানবাধিকারকর্মীদের জানিয়েছেন। এর মধ্যে ১০ হাজার ডলারের মতো দিতে হয় লিবিয়া পৌঁছানো পর্যন্ত, এরপর নৌপথের জন্য ৭০০ ডলার। ইতালির সিসিলি ও অ্যাপুলিয়ায় পৌঁছানো বেশ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মীদের বলেছেন, ওয়ার্কিং ভিসার জন্য তাদের ৩ থেকে ৪ হাজার ডলার দিয়েছেন ‘এজেন্টকে’। হানান সালেহ বলেন, ‘আমার কাছে তথ্য আছে যে লিবিয়ায় বিমান থেকে নামার পর পরই এই শরণার্থীর অনেকের কাছ থেকে সব কাগজপত্র নিয়ে তাদের একটি স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে আরও অর্থ নেওয়ার পথ তৈরি করে।’ লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে অপসারণের পর বর্তমান অস্থির পরিস্থিতি মানব পাচারকারীদের বড় সুযোগ করে দিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক নিকোলাস ম্যাকগিহান ডেইলি ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, ঢাকা থেকে দুবাই পর্যন্ত রুটটিতে অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। তারা (জনশক্তি রপ্তানিকারক) অনেক যুবকের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করে, কিন্তু সেই যুবকদের স্বপ্ন বেশির ভাগ সময় খান খান হয়ে যায়। রেমিট্যান্সের আশায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকারও জনশক্তি রপ্তানিতে এই অনিয়মের বিষয়ে উদাসীন বলে তার মন্তব্য।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার হলেও ইউরোপমুখে তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণ ব্যাখ্যা করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য রয়াল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের গবেষক গ্যারেথ প্রাইস বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরাও বাংলাদেশ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। কিছু রাজনৈতিক দলের কর্মী পরিচয়েও এই পথে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাচ্ছেন। ইউরোপ সে ক্ষেত্রে ভালো গন্তব্য। আর যদি কেউ একটা রুট তৈরি করতে পারেন, তারপর মানুষের ব্যবহারে তা দ্রুতই জমজমাট হয়ে ওঠে বলে মন্তব্য করেন প্রাইস।

লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অস্থির লিবিয়ায় কোনো সরকার না থাকায় কোনো আইন-কানুন ঠিকভাবে কাজ করছে না। এ দেশে তেমন কোনো কাজও পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরও দালাল চক্র এখানে বেশ সক্রিয়। দূতাবাস উদ্যোগ নিয়ে একাধিকবার বাংলাদেশি দালালকে পুলিশে দিয়েছে। এসব কারণে গত দুই বছরের বেশি সময় বাংলাদেশিদের লিবিয়া যাত্রা এক প্রকার বন্ধ রাখা হয়েছে। তার পরও বিভিন্ন অবৈধ পথে বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশি নাম নিয়ে লিবিয়া এসে নৌকায় ইতালি পাড়ি দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর