রবিবার, ৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

এত উচ্চ কর বিশ্বের কোথাও নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের মতো এত উচ্চহারে কর আদায়ব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও নেই বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের নীতি বিশ্লেষক, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্টজনেরা। তাদের অভিযোগ, নতুন মূল্য সংযোজন কর—মূসক বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রস্তুতি নেই। সংস্থাটির সক্ষমতাও দিন দিন চাপে পড়ছে। দেশে আমদানি, উৎপাদন ও পণ্য বিক্রির তিন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে মোট ৪৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়।

গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের (ইডব্লিউএমজিএল) কনফারেন্স রুমে কালের কণ্ঠ আয়োজিত ‘কেমন বাজেট চাই ২০১৭-১৮’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এ কথা বলেন বক্তারা। কালের কণ্ঠ সম্পাদক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল।

এ আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, এনবিআর যে রাজস্ব আদায় করে তার ৭০ শতাংশ যায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনে। বাকি ৩০ শতাংশ খরচ হয় উন্নয়নে। যদিও দেশের এক-তৃতীয়াংশ যুবক এখনো বেকার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভ্যাটের হার ১০ শতাংশ হতে হবে। কিন্তু জনগণের দেওয়া ভ্যাট আদায় করে নিজের পকেটে রাখছেন, সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছেন না, তার কী হবে? প্রতিবেশী ভারতের করপোরেট করহার ২৩ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত আদায় করা হয়। যদিও করপোরেট করের কয়েকটি ধাপ বিদ্যমান আছে। তবে আশার কথা হলো, অর্থমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন করপোরেট করহার কমানোর চিন্তা আছে। আয়কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হলে অনেক মানুষ কর দেবে। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ধনীরা যখন বুঝবেন প্রয়োজনে টাকা বাইরে নেওয়া যাবে, তখন অর্থ পাচার কমবে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ করুণাময় গোস্বামী বলেন, সরকার যে রাজস্ব পায়, তার বড় অংশ খরচ হয় বেতন-ভাতা খাতে। সরকার এরই মধ্যে বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে ফেলেছে। আমি জানি না, সরকারকে এই বেতন-ভাতা বাড়াতে কে বলেছে। হয়তো ভোটের চিন্তা করেই বাড়ানো হয়েছে। তাহলে আমার প্রশ্ন বেতন-ভাতা বাড়িয়ে কত ভোট পাওযা যাবে। তার মতে, বহুমুখী প্রাথমিক শিক্ষা পরিহার করে একমুখী করা জরুরি।

বিশিষ্ট ব্যাংকার ও নীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, বাংলাদেশের মতো এত উচ্চ আয়কর কোথাও নেই। দেশে আমদানি, উৎপাদন ও পণ্য বিক্রির তিন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে মোট ৪৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এনবিআরের সক্ষমতা দিন দিন চাপে পড়ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভোক্তা ব্যয় বা খরচ অনেক বেড়েছে। প্রতি বছর ১০ লাখ কোটি টাকা ভোক্তারা খরচ করেন। ফলে ব্যক্তি খাতের বিশাল বিকাশ হয়েছে। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার তথ্য উল্লেখ করে মামুন রশীদ বলেন, দেশের ৩ কোটি মানুষ বছরে ৫ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার (৮২ টাকা মুদ্রা বিনিময় হিসেবে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ২০ টাকা) আয় করেন। কিন্তু আয়কর দেন মাত্র ১২ লাখ করদাতা। এনবিআর নিজেও বলছে, ১ কোটি ১৪ লাখ মানুষ আয়কর দিতে সক্ষম। তার মতে, বাংলাদেশে কালো অর্থনীতির আকার মূল অর্থনীতি থেকে ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ। কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, দেশের মানুষের জীবনধারা বদলানোর বাজেট চাই। মানুষ ভালো থাকার বাজেট চাই।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ—রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হবে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে কি আমরা প্রস্তুত? এই ভ্যাট আদায়ে এনবিআর নিজেই কি প্রস্তুত? আমাদের রেজিস্ট্রেশন বাবদ দেড় থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ ভ্যাট প্রচলিত আছে। তা যদি ১৫ শতাংশ হয়, তাতে আবাসন খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনের আগে ভ্যাটের হার কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত সরকারের রাজনৈতিক বিষয়। বিশ্বের ১৪১টি দেশে ভ্যাট প্রচলিত আছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করলে চলবে না। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান—বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে এনবিআরের যে প্রস্তুতি নেই, তা বোঝা যাচ্ছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়া এবারের বাজেটে ভাবনার বিষয়।

গোলটেবিল আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন ইংরেজি ডেইলি সানের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু এবং তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার।

সর্বশেষ খবর