সোমবার, ৮ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্থলবন্দরে যত সমস্যা

স্থলবন্দরে যত সমস্যা

বেনাপোলে খোলা আকাশের নিচে কোটি কোটি টাকার মালামাল —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের স্থলবন্দরগুলোর বেশির ভাগই সমস্যা জর্জরিত। অবকাঠামো উন্নয়ন ও অন্যান্য সুবিধার অভাবে ব্যাহত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বাড়ছে পণ্য আমদানি-রপ্তানির খরচও। চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না বন্দরগুলো। কোথাও খোলা আকাশের নিচে পণ্য পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। পণ্য খালাসের দীর্ঘসূত্রতায় মালবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি জমছে। বন্দর ঘিরে গড়ে উঠেছে দুর্নীতির সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। বন্দরের এসব সীমাহীন সমস্যার কথা তুলে এনেছেন আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি বকুল মাহবুব, রেজাউল করিম মানিক, রিয়াজুল ইসলাম, মো. রফিকুল আলম, জমির বেগ্, আবদুল বারী এবং সরকার হায়দার

 

বেনাপোলের ভোগান্তি: দেশের বৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দরে পণ্য আমদানির পর দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এই বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। শুধু স্থলবন্দর নয়, দক্ষ জনবলের অভাবে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কার্যক্রমেও সৃষ্টি হচ্ছে নানা সমস্যা। দক্ষ কর্মকর্তার অভাবে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়কারী কাস্টমস হাউসে রাজস্ব আদায় নিয়ে কাস্টমস এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই লেগেই আছে। দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয় বাড়লে রাজস্ব আদায় গতিশীল হবে বলে মনে করেন আমদানিকারকরা।

বন্দরে জায়গা সংকটে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে বিভিন্ন ধরনের মেশিনারিজ, গাড়ি, কেমিক্যালসহ শত শত কোটি টাকার পণ্য। বন্দরের শেডে জায়গা না থাকায় শেডের বাইরে রেল লাইনের পাশের গর্তে পড়ে আছে ভারত থেকে আমদানিকৃত গাড়ি। বন্দরে আমদানিকৃত পণ্য রাখার শেডগুলো ব্যবহার অনুপযোগী। দেড় যুগ আগের পুরনো ও জরাজীর্ণ শেড ও ইয়ার্ড দিয়ে চলছে বন্দরের কার্যক্রম। আমদানিকৃত মালামাল লোড-আনলোডের জন্য ভাড়া করা অধিকাংশ ক্রেন ও ফর্কলিফট নষ্ট থাকায় বিঘ্ন ঘটছে পণ্য খালাসের প্রক্রিয়ায়। এদিকে বন্দরের ভিতরে নতুন শেড নির্মাণের জন্য ১০০ কোটি  টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিলেও তার উন্নয়নের গতি খুবই ধীর। ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই ট্রাক খালাসের অপেক্ষায় ৭-৮ দিন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। আমদানিকারকদের গুনতে হচ্ছে মোটা অংকের লোকসান।

বন্দরে আমদানি পণ্য রাখার ৪০টি শেডের অধিকাংশেরই মেয়াদ শেষ হয়েছে। এসব গুদামে পণ্য ধারণক্ষমতা প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু সব সময়ই বন্দরে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টন পণ্য মজুদ থাকে। দ্বিগুণ মালামাল ঝুঁকি নিয়ে রাখা হচ্ছে ঠাসাঠাসি করে। এমনকি ট্রাক টার্মিনালে বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থের মালামাল রাখা হচ্ছে।

দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানিতে গতি বাড়াতে বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোলে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক ইন্টিগেটর চেকপোস্ট। দেড় হাজার ট্রাক রাখার ব্যবস্থাসহ সব সুবিধা রয়েছে সেখানে।

পণ্যজটের কারণে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় ভারতের পেট্রাপোল বন্দর ও বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে পণ্য নিয়ে শত শত ভারতীয় ট্রাক অপেক্ষা করে প্রতিদিন। ব্যবসায়ীরা বলেন, ভারতের পেট্রাপোল বন্দরকে ভারত আধুনিকায়ন করলেও বেনাপোল বন্দরকে আধুনিকায়ন করা হয়নি।

বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার শওকাত হোসেন বলেন, রাজস্ব আদায়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে বসে বিরাজমান সমস্যার নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। জনবল সংকট অচিরেই দূর হবে। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মফিজুর রহমান সজন বলেন, স্থলবন্দরটি খুঁড়িয়ে চলছে। ধীরে ধীরে বন্দরটি ব্যবসায়িক কার্যক্রমের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

বেনাপোল স্থলবন্দর উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) রেজাউল করিম বলেন, বন্দরে ১০০ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়েছে। নতুন দুটি শেড, ফ্লোর পাকাকরণ, ড্রেন নির্মাণসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। কাজ শেষ হলে বন্দরে কোনো সমস্যা থাকবে না। পণ্যজটও কমে যাবে।

বুড়িমারী জিম্মি সিন্ডিকেটে: পুলিশ, কাস্টমস ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েক নেতার তিন সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বুড়িমারী স্থলবন্দর। দিন দিন জৌলুস হারাচ্ছে বন্দরটি। সিন্ডিকেটের বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে বাইরের ব্যবসায়ীরা এ বন্দরে আসছেন না। বিদেশ গমনকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এ বন্দর থেকে। স্থলবন্দরে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অথবা মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা পণ্যবাহী ট্রাকপ্রতি পুলিশ, কাস্টমস ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা নেন। এ ছাড়া মিথ্যা ঘোষণায় আনা স্প্রিংপাতি ও ফেব্রিক্স আমদানিকারকদের কাছ থেকে ট্রাকপ্রতি ২৫-৩০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এ ছাড়া স্থলবন্দর দিয়ে পাসপোর্টধারী যেসব যাত্রী ভারত, ভুটান ও নেপাল থেকে নৈশকোচে বাংলাদেশে আসেন, সেসব যাত্রীর লাগেজ তল্লাশির নামে পাটগ্রাম থানার ওসি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়োগকৃত লাইনম্যান হয়রানি করেন। অভিযোগ রয়েছে, একাধিক সিন্ডিকেট নেতা সকাল-সন্ধ্যা এবং প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের সময় প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণ ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করেন। মাদক, শাড়ি কাপড়, জিরা মসলা, চকলেট, অবৈধ লাগেজ ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিয়েছেন এসব নেতা। বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন হওয়ার পর যাত্রী কমলেও বন্ধ হয়নি অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি। ভারতে যেতে পাসপোর্টপ্রতি পুলিশের নামে দালালদের দিতে হয় ২০০-৩০০ টাকা, নগদ টাকা থাকলে তার ১০% দালালদের দিতে হয়। বন্দরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সপ্তাহে লাখ টাকা ভ্রমণ কর লোপাট করেন কাস্টমসের ওয়্যার হাউসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় সিন্ডিকেট। আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ট্রাকগুলোর বিপরীতে বুড়িমারী ট্রাক পরিবহন অফিস থেকে দৈনিক ১ হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা নিয়ে থাকেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভারত ও ভুটান থেকে আমদানিকৃত পাথর ও কয়লাবাহী প্রতিটি ট্রাক থেকে ৩০০ ও ফলবাহী ট্রাক থেকে ২০০ টাকা চাঁদা নেন। এসব ব্যাপারে বুড়িমারী স্থলবন্দরের সহকারী কমিশনার রেজভি আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

হিলি বন্দরের আয় কমছেই: দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই চলছে নানা সংকট আর অস্থিরতা। ভারত অংশে এখনো পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর গড়ে না ওঠায় কমে গেছে এ বন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য। বন্দর দিয়ে আসছে পাথর, পিয়াজ, কাঁচামরিচ, চাল, খৈল, ভুসি, সয়াবিন ইত্যাদি। ভারতের আমদানিকারকদের পণ্যের ছাড়পত্র নিতে ১৫০ কিলোমিটার দূরে মালদাহতে সহকারী কমিশনারের কার্যালয়ে যেতে হয়।

আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন-উর-রশিদ হারুন বলেন, অনেক সম্ভাবনা সত্ত্বেও ভারত অংশে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ বন্দর দিয়ে পর্যাপ্ত পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না। ভারত থেকে কাঁচা ফলসহ অতিরিক্ত শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে।

স্থলবন্দর পরিচালনাকারী পানামা হিলি পোর্ট লিংক লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক অসিত কুমার স্যান্নাল বলেন, হিলি পানামা পোর্ট থেকে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা আয় করে। আগের চেয়ে আয় কমার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বন্দর দিয়ে গম, ভুট্টা আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ অন্য দেশে এসব পণ্যের দাম কম। এ কারণেও আয় কমেছে।

স্থবির সোনামসজিদ: নানা জটিলতায় সোনামসজিদ স্থলবন্দরে নেমে এসেছে স্থবিরতা। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাস্টমসের বিরোধের কারণে এ বন্দর ছেড়ে অনেক আমদানিকারক অন্য বন্দরে চলে গেছেন। আমদানি কমে যাওয়ায় বেকার হতে বসেছে ১০ হাজার শ্রমিক। অন্যদিকে ২০৫ জন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লোকসানে পড়ায় তাদের প্রায় ৮০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতনভাতা না পেয়ে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছে। এদিকে প্রশাসন ম্যানেজের নামে অ্যাসোসিয়েশন প্রতিটি ফলের গাড়িতে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা চাঁদা তুলছে। এ জন্য অনেকেই এ বন্দর দিয়ে না এনে অন্য বন্দর দিয়ে ফল আমদানি করছেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সোনামসজিদ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হারুন-অর-রশিদ। অন্যদিকে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. ইসমাইল হোসেন বলেছেন, স্থলবন্দরে রাজস্ব কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। বিভিন্ন অজুহাতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গাড়ি ছাড় করতে দেরি করায়। অনেক সময় পচনশীল পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

স্থলবন্দর পরিচালনাকারী পানামা পোর্ট লিংকে ন্যূনতম সুবিধা না থাকায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বন্দরে যাতায়াতের জন্য তারা সড়ক মেরামত করছে না। এ ছাড়া গোডাউন না থাকায় মালামাল খোলা আকাশের নিচে নষ্ট হয়।

স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বন্দর ও কাস্টম সম্পাদক আবদুর রাকিব বলেন, নিয়ম অনুসারে ফলের গাড়িতে ১০% ছাড় দেওয়ার কথা থাকলেও কাস্টমস তা দিচ্ছে না। নানা হয়রানির কারণে ফল আমদানি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কিছু দিন আগেও প্রতিদিন ৪০-৫০ ট্রাক ফল আমদানি হতো। হয়রানির কারণে বর্তমানে মাত্র ৮-১০ গাড়ি ফল আমদানি হয়।

কাস্টমসের হয়রানি প্রসঙ্গে স্থলবন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কাস্টমস কমিশনারের নির্দেশে এ বন্দরে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হয়েছে। তাই বাড়তি সুবিধা না পেয়ে হয়তো ব্যবসায়ীরা এ অভিযোগ তুলছেন।

পূর্ণতা পায়নি বিলোনিয়া: ফেনীর বিলোনিয়া স্থলবন্দরের কার্যক্রম আট বছরেও পূর্ণতা পায়নি। ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে স্থলবন্দরের কার্যক্রম। ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর বিলোনিয়া শুল্ক স্টেশনকে উন্নীত করে শুরু হয় স্থলবন্দর কার্যক্রম। বিলোনিয়ার ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ভারতের সেভেন সিস্টারের সঙ্গে বাণিজ্যই ছিল এ বন্দরের মূল লক্ষ্য। এ বন্দর দিয়ে প্রথম দুই বছর ইট, সিমেন্ট, পাথর, সুড়কি, রড, চুন, লোহার ব্লেড রপ্তানি হতো। বর্তমানে শুধু সিমেন্ট, পাথর ও কিছু ঢেউটিন রপ্তানি হচ্ছে। ইট রপ্তানির ফলে দেশ থেকে প্রচুর মাটি চলে যাওয়ায় সরকার ইট রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত থেকে কোনো পণ্যই আমদানি হয় না এ বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া প্রতি মাসে প্রায় তিন-চারশ লোক এ বন্দর দিয়ে দুই দেশে  যাতায়াত করছে।

ব্যবসায়ী মো. নাছির বলেন, স্থলবন্দরের রাজস্ব আদায় করার জন্য ডিআর চালানের জন্য একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখা বা বুথ থাকা দরকার, কিন্তু তাও এখানে নেই। কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার ও থাকার ব্যবস্থা পর্যন্ত এখানে নেই। ওয়্যার হাউস ও ট্রাক ইয়ার্ড নির্মাণসহ অবকাঠামোর কোনো উন্নয়ন হয়নি। রেলপথ থাকলেও ১৮ বছর রেল যোগাযোগ বন্ধ।  আমদানি ও রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, রপ্তানির জন্য দেশের দূর-দূরান্ত থেকে এ বন্দরে গাড়ি করে মাল নিয়ে এলেও চালক-শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বিলোনিয়া স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকতা ফজলুল হক ভূঁইয়া জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই বন্দর দিয়ে ৪৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩ টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আমদানি নেই। শীত মৌসুমে রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও বর্ষা মৌসুমে রপ্তানি হয় না বললেই চলে।

বিরল বন্দর চালুই হল না: এক যুগ বন্ধ থাকার পর চলতি মাসে দিনাজপুরের বিরল সীমান্ত দিয়ে রেলপথে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি শুরু হলেও আজও চালু হয়নি বিরল স্থলবন্দর। অবকাঠামো নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ করলেও চুক্তি অনুযায়ী সড়ক, রেল লাইন যোগাযোগ এবং বাণিজ্য চুক্তি না থাকায় বন্দরটি চালু করা যায়নি।

দিনাজপুর কাস্টমস ও ভ্যাট অধিদফতর মনে করে এটি চালু হলে একদিকে যেমন বাড়বে রেলের আয় তেমনি বাড়বে রাজস্বও। এদিকে দিনাজপুর শহর থেকে হিলি স্থলবন্দরের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার সেখানে বিরল স্থলবন্দরের দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার।

দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন জানান, ল্যান্ডপোর্ট চালু করার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতায় এটি চালু হয়নি।

বেসরকারি বিরল পোর্ট ল্যান্ড লিমিটেডের এমডি সহিদুর রহমান পাটোয়ারি মোহন জানান, চুক্তি অনুযায়ী সংযোগ সড়কসহ সড়কপথ এবং স্থলবন্দরের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমিতে রেল লাইন এবং ভারত-বাংলাদেশের সঙ্গে সড়কপথে আমদানি-রপ্তানির চুক্তি হলেই বিরল স্থলবন্দর চালু হবে।

চালুর অপেক্ষায় চিলাহাটি বন্দর: নীলফামারীর চিলাহাটি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ ফের চালুর বিষয়টি উত্তরাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু চিলাহাটি আন্তর্জাতিক চেকপোস্টটি কাগজে-কলমে চালু থাকলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে সেটি বন্ধ রয়েছে। চিলাহাটি স্থলবন্দর মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের পর ২০১৩ সালের আগস্টে গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাড়া না পাওয়ায় সেটি চালু হচ্ছে না।  চিলাহাটি স্থলবন্দর বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি আবু মুসা মাহমুদুল হক বলেন, গত মার্চ মাসে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের একটি দল রেলপথ পুনঃ স্থাপনে জরিপ চালায়। ভারতের হলদিবাড়িতে কাস্টমস অফিস স্থাপন এবং কার্যক্রম শুরু করলে চিলাহাটিতে বিদ্যমান কাস্টমস অফিসটি চালু করা হবে এবং তাত্ক্ষণিকভাবে স্থলবন্দরের কাজ শুরু হবে।  সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) নীলফামারীর সভাপতি প্রকৌশলী সফিকুল আলম ডাবলু বলেন, স্থলবন্দরটি চালু হলে এ অঞ্চলের বাণিজ্যের বিকাশ হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে। বন্দর চালু হলে ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়বে।

সম্ভাবনাময় বাংলাবান্ধা: পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সীমান্তে অবস্থিত বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্যটন খাতে বিপুল রাজস্ব আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ব্যবসার পাশাপাশি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট হিসেবে ব্যবহার করছেন পর্যটকরা। সুযোগ এসেছে এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর। এ জন্য বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু হয়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক যাত্রী এই ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ব্যবহার করেছেন।

১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নেপালের সঙ্গে এই স্থলবন্দর দিয়ে প্রথম বাণিজ্য শুরু হয়। এরপর ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় ভারতের সঙ্গে। গত ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে ভুটানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা, অচিরেই চীনের সঙ্গে এই বন্দর দিয়ে বাণিজ্য কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেবে সরকার। বাংলাবান্ধা থেকে ভারতের শিলিগুড়ির দূরত্ব ১০ কিলোমিটার, নেপালের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার ও ভুটানের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশনের পর ইতিমধ্যে চার দেশের মধ্যে যাতায়াতের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। এই স্থলবন্দর থেকে চীনের দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার। ব্যবসায়ীদের আশা, অবকাঠামোর উন্নয়ন করে চীনের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন হলে উভয় দেশই লাভবান হবে। পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আশরাফুল আলম পাটোয়ারি বলেন, বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে চীন যুক্ত হলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত হবে।  তবে বাংলাবান্ধায় এখনো নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। নেই দূরপাল্লার পরিবহন ব্যবস্থা। পঞ্চগড় মোটর মালিক সমিতির কাছে অনেকটা জিম্মি পর্যটকরা। লাগেজ বহনের নেই কোনো ট্রলি। অসুস্থ রোগীদের জন্য নেই হুইল চেয়ার। নেই ভালো মানের আবাসিক হোটেল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে ৩৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর