বুধবার, ১০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুই কক্ষের পার্লামেন্ট ইস্যুতে স্থায়ী কমিটিতে তুমুল হৈচৈ

মাহমুদ আজহার

দুই কক্ষের পার্লামেন্ট ইস্যুতে স্থায়ী কমিটিতে তুমুল হৈচৈ

নতুন ধারার রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এ নিয়ে সোমবার রাতে বেগম খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সদস্যদের মধ্যে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ইস্যুতে ব্যাপক   হৈচৈ হয়। অধিকাংশ সদস্যই এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে স্থায়ী কমিটির সভা মুলতবি করা হয়। ফের গতকাল সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টানা আলোচনা করে খসড়া ভিশন-২০৩০ এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় বিএনপির স্থায়ী কমিটি। আজ বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে তা উপস্থাপন করবেন বিএনপি প্রধান। স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার খসড়া ভিশন-২০৩০ এ আড়াইশ দফা রয়েছে। এর মধ্যে ৬ষ্ঠ দফায় আলোচনায় আসে দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ। সেখানে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রের এককেন্দ্রীর চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সম্প্রদায়, প্রান্তিক গোষ্ঠী ও পেশার জ্ঞানীগুণী ও মেধাবী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ এ বক্তব্যের পরপরই শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই এই দফার বিরোধিতা করেন। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলেও তারা যুক্তি দেখান। একপর্যায়ে স্থায়ী কমিটি একমত হয়, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট নিয়ে ভবিষ্যতে আরও আলোচনা-পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাই ভিশনে খালেদা জিয়া দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে জোরালো কোনো বক্তব্য থাকবে না বলে জানা গেছে।

জানা যায়, ভিশনে বেগম জিয়া সংসদকে কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দেবেন। ক্ষমতায় গেলে ডেপুটি স্পিকার, সংসদীয় কমিটিতে সভাপতি করাসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে বিরোধী দলের যোগ্য এমপিদের নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দেবেন বিএনপি প্রধান। এ ছাড়া ভিশনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য ‘ওভারটাইম ডিউটি ফি’ দেওয়ার ঘোষণাও আসতে পারে। নতুন প্রজন্মের জন্য বিশেষ বার্তা থাকবে।

জানা যায়, সোমবার রাত সোয়া ৯টা থেকে টানা চার ঘণ্টা ভিশন-২০৩০ নিয়ে আলোচনা হয়। এর বড় অংশ জুড়েই ছিল দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ইস্যুটি। টানা আলোচনার একপর্যায়ে রাত ১২টার পর অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে চলে যান স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য। এরপরও খালেদা জিয়া পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েও রাত দেড়টা পর্যন্ত ভিশন-২০৩০ নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিরোধিতা করেন। একপর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়া সংশ্লিষ্টদের বলেন, ‘এই ভিশনের সঙ্গে আরও কয়েকজন রাজনীতিবিদ যুক্ত করা উচিত ছিল।’

এ প্রসঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘ভিশন-২০৩০’-এর খসড়া নিয়ে স্থায়ী কমিটিতে পক্ষে বিপক্ষে মত এসেছে। আমরা মনে করি, এটাই গণতন্ত্রের শোভা। বিএনপির মতো গণতান্ত্রিক দলে এটা স্বাভাবিক। আলোচনা-পর্যালোচনা করে গতকাল স্থায়ী কমিটির মুলতবি বৈঠক শেষে ভিশন-২০৩০ চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে স্থায়ী কমিটি।’

সূত্রে জানা যায়, স্থায়ী বৈঠকে স্থায়ী কমিটির বাইরেও দুজন বুদ্ধিজীবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই দুজনসহ আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবী খালেদা জিয়ার খসড়া ভিশন-২০৩০ তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই দুজন হলেন অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ ও সাবেক আমলা ইসমাইল জবিউল্লাহ। খালেদা জিয়ার অনুমতি নিয়েই ওই দুজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বলে জানা যায়। তবে এ নিয়ে বৈঠকের শুরুতেই স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘ওনারা তো আমাদের শেখাবেন, প্রশিক্ষণ দেবেন। তারা ভিশন-২০৩০ তিন মাস ধরে তৈরি করেছেন। আমরা তো মূর্খ, আমাদের বোঝার জন্য তিন দিনও সময় দেবেন না— তা কী করে হয়। বুদ্ধিজীবীরাই যদি সব সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে বলে দেওয়াই ভালো ভিশন-২০৩০ কণ্ঠভোটে পাস হয়ে গেছে। এখানে আমাদের মতামতের প্রয়োজন কী?’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘এই ভিশনের বিরোধিতা করেছে অধিকাংশ সদস্যই। তবে আমাদের চেয়ারপারসনের সম্মান রক্ষার্থেই এ ভিশন ঘোষণা করা হবে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ড. মাহবুব উল্লাহকে দেখে সবাই বিরক্ত হন। কোনো কিছু ব্যাখ্যার দরকার হলে ডেকে নেওয়া যেত। তাছাড়া মিটিংয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ তো ছিলই। তিনিও তো সব ব্যাখ্যা দিতে পারতেন।’

জানা যায়, এক সিনিয়র সদস্য চেয়ারপারসনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ম্যাডাম আপনি যখন ক্ষমতায় যাবেন তখন ভিশন দেবেন। এখন এই ভিশনের কোনো প্রয়োজন নেই।’ এক সময়ে যুব রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রসঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে বলেন, ‘এটা কোনোদিনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এটা হবে না। বাদ দেন এটা। এটা করা যাবে না। এ সময় খালেদা জিয়া বলেন, ‘সমস্যা কী, আস্তে আস্তে বলো। বুঝিয়ে বলো।’ এরপরও ওই নেতা বলেন, ‘এ ভিশন বাস্তবায়ন হবে না।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘দেশটাকে ভাগ করা যাবে না। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট করলে ভারতের মতো বাংলাদেশ কয়েকটি প্রদেশে ভাগ হবে। এটা ঠিক না। প্রতিটি প্রদেশের একজন করে মুখ্যমন্ত্রীসহ আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো থাকবে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দর্শনের বিপরীত। কারণ তিনি চেয়েছেন, দেশের অখণ্ডতা। এটাই শক্তি।’

খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুল ছাড়াও সোমবার রাতে বৈঠকে অংশ নেন, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তবে মুলতবি বৈঠকে যাননি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, স্থায়ী কমিটির এ বৈঠকটি ছিল বেশ স্মরণীয়। এমন প্রাণবন্ত তর্কবিতর্কের বৈঠক এর আগে কখনো হয়নি।

বিতর্কের বিষয়টি এড়িয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভিশন-২০৩০ আগামী প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি তাদের মেধাকে কাজে লাগাতেই সহায়তা করবে।’

সর্বশেষ খবর