বুধবার, ১০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

আসামিদের ধরতে বাসায় অভিযান, সবাই সিলেটে

নিজস্ব প্রতিবেদক

আসামিদের ধরতে বাসায় অভিযান, সবাই সিলেটে

রাজধানীর বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হওয়ার আগে বনানী থানার ওসি দুই অভিযোগকারীকে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওসি বি এম ফরমান আলী তাদের জানিয়েছিলেন, ‘ওরা তো হাইক্লাস সোসাইটির মানুষ। খামাখা মামলা না করে আপনারা সমঝোতা করে নেন। এতে আপনাদের মানসম্মানও বাঁচবে। কেউ বিষয়টি জানতেও পারবে না।’ কিন্তু ওই দুই অভিযোগকারী বলেছিলেন, ‘এদের মতো নরপশুদের শাস্তি হওয়া দরকার।’ শেষ পর্যন্ত রবিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) দুই অভিযোগকারীকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠানোর সময়ও ওসি তাদের সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে ওসি নিজেই ওই দুই তরুণীর চরিত্র হননে মাঠে নামেন। এমন অভিযোগ মাথায় নিয়ে ওসি সোমবার রাতে পারিবারিক কারণ দেখিয়ে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের গুলশান বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। গতকাল বিকালে বানানীর ‘দি রেইনট্রি ঢাকা’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বন্ধুদের যোগসাজশে ধর্ষণের ঘটনায় দুই তরুণীর করা মামলার তিন দিন পর এর তদন্তভার পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে ন্যস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ডিএমপি কমিশনারের আদেশে মামলার দায়িত্বভার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে ন্যস্ত করা হয়েছে। তবে এখনো কোনো আসামি গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অন্যতম আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। গতকাল সকালে গুলশান-২ এর ৬২ নম্বর রোডের ২ নম্বর ‘আপন ঘর’ নামে ডুপ্লেক্স বাড়িতে এবং সিলেটে সাফাতের নানার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। তবে তাকে খুঁজে পায়নি। পুলিশ বলছে, সাফাতসহ মামলার অন্য আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে। এদিকে আসামিরা বিষয়টি মীমাংসা করতে প্রস্তাব দিয়েছে বলে ভুক্তভোগী দুই তরুণীর একজন জানিয়েছেন। সোমবার বিকালে সাফাত আত্মগোপনের জন্য সিলেটের রিজেন্ট পার্ক রিসোর্টে যান। তার সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন। বিষয়টি নিশ্চিত করে রিসোর্টের ইনচার্জ হেলাল আহমেদ, ম্যানেজার বখতিয়ার ও রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার মোবারক সাংবাদিকদের বলেন, তারা রুম বুকিংয়ের জন্য এসেছিল। তাদের লাগেজ না থাকলেও প্রাইভেটকার সঙ্গে ছিল। বুকিংয়ের জন্য আইডি কার্ড চাওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হন। এ নিয়ে ম্যানেজার মোবারকের সঙ্গে সাফাতের বাগবিতণ্ডা হয়। রুম বুকিং না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তারা রিসোর্ট ত্যাগ করেন। পুলিশ বলছে, বনানী থানার এসআই রিপন কুমার ও এসআই মিল্টন দত্তের নেতৃত্বে ছয়জন পুলিশ সাফাতের বাসায় ঢুকে তল্লাশি চালায়। দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই অভিযান শেষে দুপুরে তারা বাসা থেকে বের হয়ে আসে। এ সময় এসআই রিপন কুমার সাংবাদিকদের জানান, বাসায় সাফাতকে পাওয়া যায়নি। তার পাসপোর্টটিও বাসায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। সোমবারও পুলিশ সাফাতের বাড়িতে নিষ্ফল অভিযান চালায়। এসআই মিল্টন দত্ত বলেন, সাফাতের বাসা থেকে কিছু আলামত জব্দ করেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না। অভিযান শেষে সাফাতের বাবা ও আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ তার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় গণমাধ্যমকর্মীরা তার মুখোমুখি হয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, আমার ছেলে ব্ল্যাকমেইলের শিকার। এরপর সাংবাদিকদের আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যান। তার গাড়ির ধাক্কায় দুজন সংবাদকর্মী আহত হন। সাফাতের বাবা দিলদার আহমেদ দাবি করছেন, তার ছেলে বাসায় ছিলেন। দিলদার আহমেদের এ তথ্য সঠিক নয় বলে পুলিশের অভিযোগ। বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন বলেন, সাফাতের বাসায় পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। তার বাবা মিথ্যা বলেছেন। উনি হয়তো ভেবেছেন, পুলিশ তদন্তে কোনো প্রমাণ পায়নি বলে তাকে এখনো গ্রেফতার করেনি। সে বাসায় আছে বললে হয়তো তাকে সবাই নির্দোষ ভাববে বলে ভেবেছেন। এ বিষয়ে দিলদার আহমেদ বলেন, পুলিশ প্রতিদিনই আমার বাসায় অভিযান চালাচ্ছে। সাফাতকে তারা খুঁজছে। সে কোথায় আছে তা বলতে পারছি না, কারণ সে আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করছে না। তবে একটি সূত্রে জানা গেছে, সাফাত তার চার বন্ধুকে নিয়ে সিলেটে অবস্থান করছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। সিলেট মহানগর ও জেলা পুলিশের কয়েকটি দল তাকে গ্রেফতার করার জন্য সিলেটের গোলাপগঞ্জে সাফাতদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। ঘটনার পর থেকেই আসামি সাদমান বিষয়টি সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে আসছে। ভুক্তভোগী এক তরুণী বলেন, আমাদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, আমরা মেয়ে, আমাদের ভবিষ্যৎ রয়েছে, রয়েছে আমাদের পরিবারও। কিন্তু আমি এবং আমার বান্ধবী আপস করতে রাজি হইনি। আমি বিষয়টি নিয়ে আগেই কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভয়ে পারিনি। ভাইবারে সাদমান সাকিফের সঙ্গে বাদীর কথপোকথনের স্কিনশট থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে এত দিনেও আসামিরা গ্রেফতার তো দূরের কথা তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভুক্তভোগী দুই তরুণী।

মানবাধিকার সংস্থার কমিটি : বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। শিগগিরই এই ঘটনা তদন্ত করে গণমাধ্যমে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে বলে গতকাল বিএমবিএসের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি জানানো হয়েছে। সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, ধর্ষণের অপরাধে কঠিন শাস্তির বিধান থাকলেও আমাদের দেশে তার বাস্তব প্রতিফলন নেই। তাই এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে অপরাধীরা। এ জঘন্য ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। এর আগে সোমবার ধর্ষণ মামলা নিতে পুলিশের সময়ক্ষেপণ ও তদন্তে গড়িমসির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (জামাকন)। ১৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২৮ মার্চ বনানীর ‘দি রেইন ট্রি ঢাকা’ হোটেলে সাফাত আহমেদ নামে এক বন্ধুর জন্মদিনে যোগ দিতে গিয়েই বন্ধুদের যোগসাজশে ধর্ষণের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই ছাত্রী। ৬ মে সন্ধ্যায় বনানী থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন (মামলা নম্বর-৮) ভুক্তভোগী তরুণীদের একজন। মামলায় সাদনান সাকিফ, তার বন্ধু সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সাফাতের ড্রাইভার বিল্লাল ও তার দেহরক্ষী আজাদকে আসামি করা হয়েছে। জানা গেছে, দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত পাঁচজনের তিনজনই প্রভাবশালী পরিবারের। অভিযুক্ত সাদমান সাকিফ রেগনাম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হোসাইন জনির ছেলে। আর সাফাত আহমেদ আপন জুয়েলার্সের মালিকদের একজন দিলদার আহমেদের ছেলে। নাঈম আশরাফ ই-মেকার্স বাংলাদেশের মালিক এবং একজন আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে বলে দাবি করে নিজেকে।

সর্বশেষ খবর