মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
দুই রিভিউ খারিজ

সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল

আহমেদ আল আমীন

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডই দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জনাকীর্ণ বিচারকক্ষে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির একটি নির্দিষ্ট বেঞ্চের পক্ষে গতকাল দুটি রিভিউয়ের রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। শুনানি শেষে আদালত সরকার ও আসামিপক্ষের রিভিউ আবেদন খারিজ করেছেন। এর ফলে বাকি জীবন কারাগারেই কাটাতে হবে জামায়াতে ইসলামীর এই নায়েবে আমিরকে। প্রায় আড়াই বছর আগে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। পরে সাজা বাড়াতে সরকার এবং খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন করে আসামিপক্ষ। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে শুনানি শেষে গতকাল সেই রিভিউ আবেদন খারিজ হয়েছে। ফলে সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রয়েছে। সাঈদীর এই মামলার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধবিষয়ক সপ্তম রিভিউয়ের নিষ্পত্তি হলো।

‘ন্যায়বিচার পাইনি’ : আদালত প্রাঙ্গণে সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল বিভাগের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা যেসব প্রমাণ ও দলিল দাখিল করেছি, তাতে সাঈদীর এক দিনের সাজাও হওয়ার কথা নয়। একমাত্র খালাসই ছিল আমার পিতার জন্য ন্যায়বিচার। তবু সর্বোচ্চ আদালতের রায় আমাদের মানতে হবে, শ্রদ্ধা দেখাতে হবে।’ মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাজা কমিয়ে আমৃৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। সাঈদী এখন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে তিনি কারাবন্দী। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আসামিপক্ষে রিভিউ শুনানি করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান।

তিন অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড : দশম, ষোড়শ ও ঊনবিংশ অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে সাঈদীকে। দশম অভিযোগ অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২ জুন সকালে পিরোজপুরের ইন্দুরকানি এলাকার উমেদপুরের হিন্দুপাড়ার ২৫টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে সাঈদীর নেতৃত্বে এক সশস্ত্র দল। আসামির ইন্ধনে গুলি করে হত্যা করা হয় বিশাবালীকে। ষোড়শ অভিযোগের তথ্যমতে, সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জন রাজাকারের একটি দল বাড়ি থেকে ধরে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায় পাড়েরহাটের গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোনকে। তিন দিন ধর্ষণের পর ছাড়া পান তারা। ঊনবিংশ অভিযোগের তথ্য অনুসারে, পাড়েরহাটসহ অন্য এলাকার এক-দেড়শ’ হিন্দুকে প্রভাব খাটিয়ে ইসলামে দীক্ষিত করেন সাঈদী। এ ছাড়া সপ্তম ও অষ্টম অভিযোগে মোট ২২ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে আসামিকে। এর মধ্যে অষ্টম অভিযোগের অংশবিশেষ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। সপ্তম অভিযোগে ১০ এবং অষ্টম অভিযোগের অংশবিশেষের জন্য ১২ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে সাঈদীকে।

বিচার প্রক্রিয়া : দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গ্রেফতার হন ২০১০ সালের ২৯ জুন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একটি মামলা করেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী। ওই বছরের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দেখানো হয় সাঈদীকে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্ত করেন এএসপি হেলাল উদ্দিন। তদন্ত চলে ২০১০ সালের ২১ জুলাই থেকে পরের বছরের ৩০ মে পর্যন্ত। ২০১১ সালের ১১ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ১৪ জুলাই অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ২০ অভিযোগে সাঈদীর বিচার শুরু হয় ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর। প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৮ জন। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৫ জনের জবানবন্দিকে তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল। সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেন ১৭ জন। যুক্তিতর্ক শুরু হয় ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর থেকে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১। স্কাইপে কথোপকথনের জের ধরে পদত্যাগ করেন বিচারপতি নিজামুল হক। পরে বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হলে উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয় আবার। এরপর ২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেন বিচারিক আদালত। পরে খালাস চেয়ে আপিল করেন সাঈদী। আর প্রমাণের পরও যেসব অভিযোগে আসামিকে দণ্ড দেওয়া হয়নি সেসব অভিযোগেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে সরকার। শুনানি শেষে ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ড থেকে সাজা কমিয়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ।

সপ্তম রিভিউয়ের নিষ্পত্তি : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ পর্যন্ত সাতটি রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়েছে আপিল বিভাগে। প্রথমে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ-সংক্রান্ত আবেদনের নিষ্পত্তি হয়। এরপর একে একে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মীর কাসেম আলীর পর গতকাল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রিভিউ আবেদনেরও নিষ্পত্তি হলো আদালতে।

সর্বশেষ খবর