বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্যাকেজিংয়ের আড়ালে অনিয়ম

বন্ড সুবিধায় শুল্ক ফাঁকি

রুহুল আমিন রাসেল

রপ্তানি পণ্য প্যাকেজিংয়ের আড়ালে শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার নামে অনিয়ম চলছেই। তৈরি পোশাকসহ কয়েকটি শিল্পের পণ্য প্যাকেজিংয়ের আমদানি হওয়া বেশ কিছু কাগজ জাতীয় পণ্য এখন কালোবাজারিদের হাতে। ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। বন্ডে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ৮৩ প্রতিষ্ঠানের ৯৭৪ কোটি টাকার পণ্য আটক হয়েছে। এই আটক পণ্যে ৪৫৮ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. মইনুল খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বন্ডের অনিয়ম ও পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির বিরুদ্ধে শুল্ক গোয়েন্দার নিয়মিত অভিযান চলছে।

তারই আলোকে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ৮৩টি প্রতিষ্ঠানে সফল অভিযান চালিয়ে অবৈধ পণ্য আটক করা হয়েছে। জানা গেছে, তৈরি পোশাকসহ কয়েকটি শিল্পের রপ্তানি পণ্য প্যাকেজিংয়ের নামে শুল্ক সুবিধায় আমদানি হওয়া আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কার্বনলেস পেপার, হার্ড টিস্যুসহ বেশ কিছু কাগজ জাতীয় পণ্য এখন কালোবাজারিদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। যদিও দেশীয় স্বয়ংসম্পূর্ণ কাগজশিল্প মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ওইসব কাগজ পণ্য উৎপাদন করছেন। কিন্তু বন্ডের পণ্য চোরাকারবারিতে জড়িত ব্যবসায়ীরা খোলাবাজারে বিক্রি করায় দেশীয় কাগজশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হওয়ার দশায় রয়েছে। ফলে একদিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে। অপরদিকে দেশীয় কাগজশিল্প মালিকদেরও ঘুম হারাম হচ্ছে শিল্প ধ্বংসে কাস্টমসের নির্লিপ্ততা দেখে।

শুল্ক গোয়েন্দা জানিয়েছে, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ৮৩টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, কার্বনলেস পেপার, হার্ড টিস্যুসহ কাগজ জাতীয় বিভিন্ন পণ্য আটক করা হয়, সেগুলো হলো— নাভানা পলি, ওয়েব কোর্টস লিমিটেড, নাভানা পলি প্রিন্টিং, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, এলফিশ লিমিটেড, মিলেনিয়াম এক্সেসরিজ, মেসার্স প্লাস্টিক সাইন, সাগর প্যাকেজিং, গোধূলী প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, বিপি এক্সেসরিজ, সাদমা ফ্যাশন, কসমো লিমিটেড, মেসার্স হানজি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মেসার্স ব্রান্ড মার্চেন্ডাইস প্যাকেজিং, মেসার্স ভেকি প্যাকেজিং লিমিটেড, দেজ সোয়েটার লিমিটেড, সানরাইজ এক্সেসরিজ লিমিটেড, লিবার্টি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, ফেডারেল করপোরেশন লিমিটেড, কোয়েস্ট এক্সেসরিজ লিমিটেড, এফএল গার্মেন্টস এক্সেসরিজ লিমিটেড, চৌগাছা প্রিন্টিং লিমিটেড, এসএম প্যাকেজিং, তরী প্যাকেজিং লিমিটেড, রূপালী এক্সেসরিজ লিমিটেড, ফিউচার এক্সেসরিজ লিমিটেড, আউয়াল পলিমার লিমিটেড, আইডিয়াল পলিমার লিমিটেড, ফ্লোরিয়ান এক্সেসরিজ লিমিটেড, বিপি এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও নাহিদ প্লাস্টিকসহ ৮৩টি বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, দেশের প্রায় ৮৫টি কাগজ কারখানায় আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কার্বনলেস পেপার, হার্ড টিস্যুসহ কাগজ জাতীয় বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় এই উৎপাদন স্থানীয় শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা পূরণে পুরোপুরি সক্ষম। তা সত্ত্বেও শুল্কমুক্ত সুবিধায় চীন, ভারত, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কাগজ জাতীয় এসব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। তার ওপর বিনাশুল্কে আমদানি করা এসব পণ্য আইন ভেঙে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় সব নিয়ম মেনে রাজস্ব দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করতে গিয়ে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে দেশি কাগজ মিলগুলো। কারণ বিনা শুল্কে আমদানি করা পণ্য দেশে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে গড়ে টনপ্রতি ২০ হাজার টাকা কমে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে। জানা গেছে, এই অনিয়ম বন্ধ করার দায়িত্ব ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা চোরাকারবারিদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখেন। বন্ড লাইসেন্স নিয়ে আমদানি করা কাগজ জাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার তথ্য মিলেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনেক শক্তিশালী ও সমাজে প্রভাবশালী হওয়াতে ব্যবসায়ীরা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছেন। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের তথ্যমতে, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলো পুনঃ রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির সুযোগ পায়। বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার আওতায় রপ্তানির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি হয়েছে দিনের পর দিন। ফলে প্রতিবছর শুধু আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়ে থাকে সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতির হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হলে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে। এ সুবিধার আড়ালে বন্ডেড ওয়্যার হাউসে অনিয়মের শেষ নেই। পুনঃ রপ্তানির শর্তে আমদানি করা কাপড় ও কাগজসহ অন্যান্য পণ্য ফ্রি-স্টাইলে বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। প্রসঙ্গত, রপ্তানিতে সহযোগিতা করতে সরকার শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামাল বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে কাগজ আমদানির সুযোগ দেয়। অর্থাৎ একটি রপ্তানিমুখী কারখানার উৎপাদনে ব্যবহূত সব কাঁচামাল কোনো ধরনের শুল্ক না দিয়েই আমদানি করা যাবে। এ শুল্কমুক্ত সুবিধা ‘বন্ড সুবিধা’ নামে পরিচিত।

সর্বশেষ খবর