শিরোনাম
শনিবার, ২০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভোটারদের তিক্ত অভিজ্ঞতাজনিত অবিশ্বাস

এম জে আকবর

ভোটারদের তিক্ত অভিজ্ঞতাজনিত অবিশ্বাস

রাজনীতির লোকরা কল্যাণকর কাজের শক্তি হয়েছে, এমন সংবাদ ভারতীয় ভোটাররা চটজলদি খুব কমই বিশ্বাস করে। তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের আগলে রাখে। কিন্তু তারা যখন দেখে জাতীয় সরকারটা গতিময় কাজ করছে, ইতিবাচক আর লক্ষ্য অর্জনে স্থিরচিত্ত, তখন তারা শুধু দ্রুত বিশ্বাস তো করেই, দিগন্ত স্পর্শ করার ব্যাপারেও আস্থাবান হয়ে ওঠে। ভোটাররা রগচটা হয়েছিল ২০১৪ সালে। হওয়ার যুক্তিও ছিল যথেষ্ট। দশক ধরে ডুবন্ত প্রবৃদ্ধি আর দুর্নীতির তীব্রতায় ভোটারদের মোহমুক্তি ঘটেছে। তারা হয়েছে নিরাশ। হতাশা প্রগাঢ় হতে হতে ক্রোধের রূপধারণ করেছিল। কিন্তু নয় মাসের নির্বাচনী প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদি তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিমাধুর্য দিয়ে জনমানসকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করে তুলেছিলেন।

সমস্যা হলো, পরিবর্তন তো জাদুকরি গতিতে ঘটে না। নির্বাচনী ফলাফল দেখে স্তম্ভিত বিরোধী দলগুলো দাবি তোলে, ‘সুফল এখনই দেখাও’। তারা কোমর বেঁধে যেভাবে মাঠ গরম করতে লেগেছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল যে, তারা ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার জন্য বেশ উতলা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্নায়ু অবশ্য ইস্পাতে চুবানো। তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে আস্থা ফিরে এসেছে; ফিরেছে আত্মবিশ্বাস। এ বিষয়ে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী ফলাফলকে গণতন্ত্রের প্রাকৃতিক ব্যারোমিটার বলা যায়। তবে যেখানে নির্বাচন-প্রক্রিয়া চলছে না বা যেখানে নির্বাচন অত্যাসন্নও নয়, ঝড় আঘাত করেনি; কিন্তু নতুন বাতাস ফিসফিস শুরু করেছে—এমন সব জায়গার অবস্থা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

একটা ধাঁধা : ব্রিটিশ-ভারতের কোন অংশটি ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন হয়নি? উত্তর হচ্ছে : বাংলা প্রদেশের মালদহ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের একজন ম্যাজিস্ট্রেট ১৭ আগস্ট পর্যন্ত মালদহের প্রশাসক ছিলেন। মালদহ কোন রাষ্ট্রভুক্ত হবে—এই প্রশ্নে বিতর্ক ছিল। বিতর্কের কারণটা নৃতাত্ত্বিক। মালদহ হচ্ছে বাংলাদেশের লাগোয়া গরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত একটি জেলা। এই জেলা হয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদী ফারাক্কায় এসে হুগলি নদী হয়েছে। মালদহের ইতিহাস আছে, সমৃদ্ধ ইতিহাস। পৌরাণিক লিপিতে এই ভূখণ্ডকে ‘গৌড়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গৌড় ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। বিখ্যাত পাল বংশের রাজত্বকালে এবং সালতানাত ও মোগল নবাবদের কালেও ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল গৌড়।

১৯৫০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় থেকে মালদহ অবিরাম কংগ্রেসের অনুগত। মধ্য এপ্রিলে আমি মালদহ গিয়েছিলাম রাজনৈতিক কাজে। সেখানে গ্রামীণ পটভূমিতে গড়ে ওঠা গজল নামের ছোট্ট একটা শহরে জনসভা করি। আসলে ‘জনসভা’ বলা অন্যায়। দলীয় সমর্থক, কৌতূহলী মানুষ মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি লোক হয়নি।

হট্টগোল-ভরা গণতন্ত্রে বাঙালি ভোটাররা উচ্চকণ্ঠের অধিকারী হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা সময় নেয়। চিন্তা বদলে গেছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য খুব ভালো জায়গা হচ্ছে জনসভার মঞ্চ। চোখ, দেহভঙ্গি, নীরবে মাথা নোয়ানো অথবা সশব্দ করতালির সময় শ্রোতাদের মন দৃশ্যমান হয়। আমি পরিষ্কার দেখলাম, আরেকটা ঘূর্ণি শুরু হয়ে গেছে। ঘূর্ণিটা কতদূর যাবে তা নির্ভর করছে অনাগত ও অনুমানরহিত পরিস্থিতির ওপর। তবে মালদহ যদি মাপকাঠি হয় তাহলে এটা নিশ্চিত, যে কোনো শক্ত ঘাঁটিই আর বেশি শক্ত নেই।

স্থবির গ্রামীণ অর্থনীতি, বৈষম্য আর বর্ধমান কামনা-বাসনার কারণে ভোটারের মানসিক স্থিতি দেখে হতবুদ্ধি হতেই হয়। গোষ্ঠীগত আনুগত্যের ভিত্তিতে তারা ভূমিকা গ্রহণ করে অবশ্যই। কিন্তু সাত-দশকের স্থিতাবস্থাটা এখন বেসামাল হয়েছে। মূল কারণ একটাই—দুর্নীতি।

পশ্চিমবঙ্গে চাপা ক্ষোভগুলো আর চাপা নেই। সেগুলো এখন রোষের রূপ নিয়েছে। গোপনে ধারণ করা ভিডিও ছবি দেখতে পাওয়ার পরিণীতিতেই এমন হচ্ছে। টেলিভিশনে বারবার দেখানো হয় সেসব ছবি। এতে দেখা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের কতিপয় এমপি এবং রাজ্য সরকারের মন্ত্রীরা ঘুষ নিচ্ছেন আর নগদ টাকা পকেটে ঢোকাচ্ছেন। মমতা ব্যানার্জি সব সময় দাবি করতেন, তিনি উচ্চ নৈতিকতার মধ্যে জীবনযাপন করেন। সেই তিনি তার স্বভাবসুলভ মারমুখো ভঙ্গিতে। তার লোকদের উেকাচ গ্রহণের পক্ষে প্রকাশ্যে সাফাই গেয়ে জনতাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছেন। এতে করে ভোটার মনে ছাপ পড়ছে যে, অনৈতিক পন্থায় সম্পদ অর্জনের বর্ধমান সংস্কৃতির কবলিত হয়েছেন মমতার নিকট আত্মীয়রা—এই গুজব একেবারে অসত্য নয়। এখন তো বলাবলি হচ্ছে : নোট বাতিলের ঘোষণার বিরুদ্ধে মমতার প্রবল বিষোদগারের নেপথ্যে ছিল গোপন ভাণ্ডারে রাখা অর্থসম্পদ অকেজো হয়ে যাওয়ার গভীর বেদনা। ভারতের গরিবরা মনে করে, দুর্নীতি মানে জনগণের টাকা চুরি। সমাজকল্যাণ খাতে বিপুল বিনিয়োগ তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। ‘যাদের খুব দরকার উন্নয়নের ও প্রবৃদ্ধির সুফল তাদের কাছেই পৌঁছানো হবে সর্বপ্রথম। উন্নতির সবচেয়ে বড় ভাগও তাদের প্রাপ্য।’ মোদির এ কথা গরিবরা বিশ্বাস করে। তারা এটাও জানে, সময় অপচয় করার মতো সময় মোদির হাতে নেই। লেখক : ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর