মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

মন্ত্রীদের তুমুল সমালোচনা

কিছু মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে দল বিব্রত ♦ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে দায়িত্ব ছাড়ুন ♦ খালেদার কার্যালয় তল্লাশি, হেফাজত-সখ্য ও মেয়রদের বরখাস্ত নিয়ে বিতর্ক

রফিকুল ইসলাম রনি

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা হয়েছে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে। গতকাল সকালে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ সমালোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত সূত্রে এ খবর জানা গেছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, বি এম মোজাম্মেল হক, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মৃণালকান্তি দাস, আবদুস সোবহান গোলাপ, শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, ফরিদুন্নাহার লাইলী, আফজাল হোসেন, অসীম কুমার উকিল, সুজিত রায় নন্দী, আবদুস সবুর, বিপ্লব বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন। তাদের অনেকেই বক্তৃতা করেন। বৈঠকে কয়েকজন মন্ত্রীর তুমুল সমালোচনা ছাড়াও আওয়ামী ওলামা লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়। ওলামা লীগ বর্তমানে কয়েকটি ধারায় বিভক্ত। এই সংগঠনের একটি অংশের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া জেলা নেতাদের বিরোধ নিরসনের জন্য কেন্দ্রে ডেকে না এনে স্থানীয়ভাবে বসে সমাধান করলে সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন সম্পাদকমণ্ডলীর অনেক সদস্য। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে বলা হয়, কিছু মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে ১৪-দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগকেই সব দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। মন্ত্রিসভায় থেকে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাইলে দায়িত্ব ছেড়ে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয় বৈঠকে। বৈঠকে আরও বলা হয়, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে কার্যত দলটিকে চাঙ্গা করে দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া হুট করে এটা করা ঠিক হয়নি। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন সম্পাদকমণ্ডলীর কেউ কেউ।

বৈঠকে সম্পাদকমণ্ডলীর দুজন সদস্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চান, বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে পুলিশ তল্লাশি চালানো হলো। একটি বড় দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তল্লাশির আগে কি আমাদের রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল? জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তল্লাশি চালানো হয়েছে।’ তখন ওই সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের জন্য ভালো নয়। এ সময় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও  সিলেটের মেয়র আরিফুল হকের সাময়িক বরখাস্তেরও সমালোচনা করেন কেউ কেউ।

বৈঠকে ধর্ম সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়মের মধ্যে আনার জন্যই এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কয়েকজন মন্ত্রী গণমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তিনি বলেন, হেফাজতকে তো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। মন্ত্রীরা হেফাজতের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। মন্ত্রিসভায় থেকে এটা তারা করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি আর হেফাজতের স্বীকৃতি এক নয়। দেশে অনেক কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ছিল। তার একটির প্রধান ছিলেন হেফাজতের আমির আল্লামা শফী। গণভবনে হেফাজতের আমির হিসেবে তাকে ডাকা হয়নি। কওমির স্বীকৃতি দেওয়ার পর ধন্যবাদ জানিয়ে যত ফোন পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি ফোন পেয়েছি মন্ত্রীদের সমালোচনা করে গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশের পর।’ তিনি বলেন, ‘ইসলামী চিন্তাবিদসহ আলেম-ওলামারা জানতে চেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি দেন, আর সরকারের মন্ত্রীরা সমালোচনা করেন। তাহলে কোনটা সঠিক?’ জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘যারা সমালোচনা করেছেন, তারা আমাদের দলের নন। সরকারের মন্ত্রী। সুতরাং আমাদের দলের বৈঠকে এ নিয়ে কথা না বলাই ভালো।’ বৈঠক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বিরোধ মীমাংসায় স্থানীয় নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে ‘শালিস’ করার বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান। তিনি বলেন, তৃণমূলের বিরোধ মীমাংসায় স্থানীয় নেতাদের ঢাকায় ডেকে আনায় স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং আরও বাড়ছে। তার চেয়ে বরং সমস্যা সমাধানে স্থানীয়দের বেশি বেশি অন্তর্ভুক্ত করলে সুফল পাওয়া যেত। তার প্রস্তাব, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তৃণমূলের সমস্যা সমাধানে স্থানীয়ভাবে সুরাহা করার উপায় খুঁজতে হবে। জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এমন হলে অবশ্যই বিকল্প চিন্তা করতে হবে।

বৈঠকে আওয়ামী লীগের একটি আলাদা ইসলামিক ফোরাম করার কথা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আইনজীবীদের একটি পৃথক ফোরাম করেছি আমরা। আমার মনে হয়, ইসলামী একটি ফোরামও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা গতানুগতিক ফোরাম দাঁড় করাব না। আমাদের আদর্শ ধারণ করেন, এমন আলেমদের নিয়ে এই “প্লাটফরম” করা যেতে পারে।’ তবে এই প্রস্তাবের সঙ্গে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এবং অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক টিপু মুন্সি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অসামপ্রদায়িক রাজনৈতিক দল। এখানে পৃথক ফোরাম কতখানি যুক্তিযুক্ত হবে, ভেবে দেখা দরকার। এ ছাড়া আমাদের ধর্ম সম্পাদকের একটি পদ রয়েছে। এ পদের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি ইসলামী কার্যক্রমগুলো সম্পাদন করতে পারেন।’ জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ওলামা লীগ নামে আমাদের একটি ইসলামী সংগঠন ছিল। এই ফোরাম কেন হয়েছিল, আর কেনইবা নেই?’ ওলামা লীগ সম্পর্কে দলের ধর্ম সম্পাদক শেখ আবদুল্লাহ বলেন, ‘ওই সংগঠন দলাদলি ও বিতর্কিত সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। তারা ঐক্যবদ্ধ নেই। পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ওলামা লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী সেসব আলেম-ওলামাকে নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হবে।’ আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণালকান্তি দাস বলেন, ‘দলে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’ দলের সাবেক এই উপ-দফতর সম্পাদক বলেন, ‘আগামী নির্বাচনের ফলাফল সরকারের উন্নয়নের পাশাপাশি দলের নেতা-কর্মীদের আচরণের ওপর নির্ভর করবে। সেই সঙ্গে মিডিয়ার একটি ভূমিকা রয়েছে। মিডিয়া মালিক-সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ বাড়াতে হবে।’ সম্পাদকমণ্ডলীয় সভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সবাইকে নির্বাচনভিত্তিক স্থানীয় রাজনীতিতে না জড়ানোর নির্দেশ দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আগে থেকেই নির্বাচন করার মানসিকতা নিয়ে এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের খবরদারি স্থানীয় পর্যায়ে অস্থিরতা তৈরি করবে। এই মানসিকতা সবাইকে পরিহার করতে হবে। এ সময় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের রাজনৈতিক তৎপরতায় দলীয় কার্যক্রমে গতি এসেছে বলে মন্তব্য করেন। এজন্য ওবায়দুল কাদেরকে তিনি ধন্যবাদ জানান।

সর্বশেষ খবর