বুধবার, ২৪ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশির উদ্দেশ্য কী

আমীর খসরু

বেশ কিছু দিন ধরে দেশে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজমান রাখা হলেও পরিস্থিতিটি যে ভিন্ন ছিল তা সবারই চোখে পড়েছে। জোরজবরদস্তি, শক্তি ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক শান্ত পরিস্থিতির বিপরীতে বিরোধী দল বিএনপিও কৌশল পরিবর্তন করেছে। গেল কিছু দিন ধরে সরকারি দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রস্তুতি হিসেবে দলের অভ্যন্তরে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন এলাকার নেতাদের ক্ষোভ ও উদ্বেগের কথা নিজেই শুনছেন এবং বোধকরি এর ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচনের কর্মকৌশল তারা নির্ধারণ করবেন। এর বিপরীতে বিএনপিও নানাভাবে চেষ্টা করছে নানাবিধ সংকটে সংকটাপন্ন ও কোমর ভাঙা দলকে সোজা করে দাঁড় করানোর। এ লক্ষ্যে অনেকটা হঠাৎ ও অপ্রত্যাশিত হলেও ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করে দলের প্রধান খালেদা জিয়া এ কথাটিই জানান দিয়েছেন যে, তারাও আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে তার বড় ইঙ্গিতবাহী ঘটনা হচ্ছে, ভোটের রাজনীতির কারণে হেফাজতকে কাছে টানা। অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গেও তাদের কথাবার্তা চলছে— এমনটা শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বাম ঘরানার কয়েকটি দলের ওপর আর নির্ভর করে ভোটের রাজনীতির অঙ্ক কষতে চাইছে না। বিভিন্ন মহলে এমন একটা জোর ধারণা তৈরি হয়েছে যে, নির্ধারিত সময়ে হোক বা তার কিছুটা আগেই হোক, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮-তেই অনুষ্ঠিত হবে এবং এই নির্বাচনে বিএনপিও অংশ নেবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দলটি যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেদিকে তারা আর যাবে না, এও নিশ্চিত। সরকার চেষ্টা করলেও তারা যে ওই পথে যাবে না, এও মোটামুটি নির্ধারিত। বিভিন্ন সূত্রের খবর হচ্ছে, পশ্চিমা দুনিয়ার কূটনৈতিক তত্পরতাও তেমনটিই। তারা চায়, সব দলের অংশগ্রহণে, গ্রহণযোগ্য, মোটামুটি অবাধ একটি নির্বাচন হোক। আর এই নির্বাচন হলে দেশের আইনের শাসন, মোটামুটি সুশাসন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে— এমনটা তারা মনে করেন। বিশেষ করে জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত অর্থাৎ আইএসের স্থানান্তরকরণ ও কৌশল পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অবস্থানকে তারা নিবিড় ও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পশ্চিমা দুনিয়ার পক্ষ থেকে এ কথাটি ইতিপূর্বে বার বার সরকারকে বলা হয়েছে যে, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি জঙ্গিবাদের উত্থান এবং সম্ভাবনাকে ব্যাপক মাত্রায় বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশে যে ঠিক তেমনটাই ঘটেছে, এ বিষয়টিও স্মরণে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সরকার জঙ্গিবাদ ইস্যুকে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করছে। দেশে যখন একটি নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছিল, ঠিক তখনই বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশির খবরটি বিস্ময় ও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। হঠাৎ করে জোরজবরদস্তির শান্তিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে কেন বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তল্লাশি চালানো হলো? বিষয়টি তো রাজস্ব বোর্ড বা কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগের নয়। বিষয়টি নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক। কাজেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের এমন একটি কার্যক্রম ও কর্মকাণ্ড ক্ষমতাসীনদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অজ্ঞাতে ঘটতে পারে এমনটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর মধ্য দিয়ে কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কি চাচ্ছে না যে আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করুক? এবং সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক? এ প্রশ্নটিও জনমনে দেখা দিয়েছে যে, সরকার কি দমন-পীড়ন চালিয়ে, মাঠ দখল করে, স্থানীয় সরকারগুলোর আদলে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চায়? এ প্রশ্নটিও উঠেছে যে, বিএনপি নির্বাচনমুখী হোক তা সরকার চায় কিনা? উসকানি দিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে চলমান মামলা-মোকদ্দমাগুলো আরও জোরদার করে, তারা কি চায় মাঠ খালি করতে? এ কথাটি মনে রাখতে হবে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দ্বিতীয়বার একইভাবে ঘটে না। আর যদি ঘটানোর চেষ্টাও করা হয় তার ফলও ভিন্ন হতে বাধ্য। এখনো নিশ্চয়ই সময় আছে, জোরজবরদস্তির কথিত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নয়; সুস্থ, স্বাভাবিক, অবাধ, গণতান্ত্রিক পরিবেশই পারে প্রকৃত শান্তি, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে গণতন্ত্রের পথ সুগম করতে। আর এটাই হচ্ছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম। উন্নয়ন না গণতন্ত্র— সেই বিতর্ক এখন অতীতে পরিণত হয়েছে। বোধকরি সরকার বিষয়টি এত দিনে হলেও বুঝতে সক্ষম হয়েছে।

সর্বশেষ খবর