বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিলামে ওঠে হিলি স্টেশন

অংশ নেয় মাফিয়ারা, লিজ নিয়ে অবৈধ কারবার

মির্জা মেহেদী তমাল, দিনাজপুর (হিলি) থেকে ফিরে

নিলামে ওঠে হিলি স্টেশন

নিলামে ওঠে হিলি স্টেশন। উত্তরের চোরাচালানের সদর দরজা সীমান্ত ঘেঁষা এই স্টেশনটি নিলামে তোলা হয় চোরাই পণ্য ওপার-এপার করতে। চোরাচালানের শক্তিশালী মাফিয়ারা এতে অংশ নেয়। আর এই নিলাম হয় প্রতি বছর। বাংলাদেশ রেলওয়ে, রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি), থানা, অভিবাসন পুলিশের কতিপয় সদস্য মিলেমিশেই গোপন এই নিলামের আয়োজন করে থাকে। গত বছর এই নিলাম হাকিমপুর থানাতে অনুষ্ঠিত হয়। দিনাজপুর-জয়পুরহাটের সীমান্ত এলাকায় বিজিবি, পুলিশ, চোরাকারবারিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন নজিরবিহীন তথ্য মিলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, শুধু হিলি স্টেশন নয়, কোনো কোনো এলাকার রেলপথ ও ট্রেনও ইজারা দেওয়া হয় চোরাচালানের জন্য। এই অঞ্চলে চোরাচালান অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। চোরাচালান রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। জানা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে চোরাচালানের জন্য ট্রেন নিরাপদ বাহন। এ কারণে হিলি স্টেশন অস্ত্র, মাদক আর বিস্ফোরকসহ অন্যান্য চোরাই পণ্যের চোরাচালানে জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা তিতুমীর, বরেন্দ্র, উত্তরা, খুলনা থেকে ছেড়ে আসা সীমান্ত, রূপসা, খুলনা মেইল, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নীলসাগর, দ্রুতযান, তিস্তা ট্রেন হিলি স্টেশনের কাছে পৌঁছামাত্র ট্রেনের হুজপাইপ খুলে দিয়ে কোটি কোটি টাকার মাদক, অস্ত্রসহ বিভিন্ন প্রকার পণ্য ট্রেনে তোলা হয়। রেলওয়ের নিরাপত্তা কর্মীদের বিরুদ্ধে এসব চোরাচালানি পণ্য পাহারা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যেমন হিলি থেকে বিরামপুর, ফুলবাড়ী, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, রংপুর, বিরামপুর থেকে জয়পুরহাট সান্তাহার, নাটোর, ঈশ্বরদী, হিলি থেকে আন্তঃনগর ও লোকাল এবং মেইল ট্রেনগুলোতে ভারতীয় পণ্য বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। যে কারণে চোরাচালানের জন্য হিলি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। এই হিলি স্টেশনকে ঘিরেই দুই পারে চোরাচালানের যত আয়োজন চলে। হিলি স্টেশন নিলামে তোলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, নিলাম খুব গোপনে আয়োজন করা হয়। থানা ও রেলওয়ে পুলিশ পুরো বিষয়টির দেখভাল করে। উচ্চ দরে যারা এই নিলামের ডাক পেয়ে থাকে, তারাই স্টেশনকেন্দ্রিক চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের অন্যতম কাজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব সংস্থার জন্য টাকা উঠানো এবং চোরাচালান নির্বিঘ্ন রাখা। আগে একটি সিন্ডিকেট পুরো স্টেশনের দায়িত্ব পেলেও হালে তিনটি সিন্ডিকেট দায়িত্ব পালন করছে। এক্ষেত্রে স্টেশনটি তিন ভাগ করে তিনটি নিলামের ব্যবস্থা করা হয়। রেলওয়ে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, চোরাচালান মাফিয়ারা ভয়ঙ্কর। এক গ্রুপকে দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা যায় না। স্টেশনে শান্তি বজায় রাখতেই তিন ভাগ করে তিনটি গ্রুপকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় টাকা তুলছে। কেউ কারও এলাকায় গিয়ে টাকা তুলতে পারবে না। হিলি স্টেশনের কাস্টমস এলাকা থেকে উঁচু ঢিপি (বল খেলার মাঠের পাশে), কাস্টমস থেকে ফকিরপাড়া এবং উঁচু ঢিপি থেকে জিলাপি পট্টি পর্যন্ত তিন ভাগ করে নিলাম করা হয়। সূত্র জানায়, হিলির তিন মাফিয়া রায়হান হাকিম, আলম এবং হযরত উচ্চ দর হাঁকিয়ে হিলি স্টেশন লিজ নিয়েছে। এদের নিয়োজিত দুই শতাধিক লাইনম্যান স্টেশনকেন্দি ক টাকা তুলছে। কয়েকজন লাইনম্যান জানান, স্টেশনের লাইনম্যানদের দায়িত্ব বেশি। তাদের সিগনাল ছাড়া কোনো মালামাল এপার-ওপার করতে পারে না। সিগনাল ছাড়া মাল এপার-ওপার করলেই দায়দায়িত্ব মালের মালিকের। ফিরোজ নামে একজন লাইনম্যান জানান, তাদের কাজই হচ্ছে চোরাচালানিদের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা, তাদের কাছ থেকে যথাযথ কমিশন নিয়ে সেভাবে দেখভাল করা আর নিরাপদে রাস্তা পার করে দেওয়া। লাইনম্যানদের কয়েকজন জানায়, তারা একেকজন একেক সংস্থার হয়ে কাজ করে। একজন দুই সংস্থার কাজ করতে পারে না। সব ঘাটে জমা দেওয়ার পর একজন লাইনম্যানের প্রতিদিন চার-পাঁচ হাজার টাকা করে থাকে। আর বড় চালান হলে আয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে হেরোইন, ইয়াবা বা ফেনসিডিলের বড় চালান হলে মোটা অঙ্কের টাকা থাকে। এসব চালানে কোনো স্লিপ দেওয়া হয় না। এই লাইনম্যানের কাজ পেতে অনেক সময় বড় বড় চোরাচালানিকে অগ্রিম হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা জামানত দিতে হয়। লাইনম্যানরা জানিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের কাছে মোবাইল ফোন আছে। চোরাচালানিরা মালামাল এপার-ওপার করার আগে তাদের কাছে লাইন ক্লিয়ারেন্স চায়। এ সময় তারা বিজিবি, বিএসএফ, পুলিশসহ সবার সঙ্গে কথা বলে তাদের সম্মতি নিয়েই লাইন ক্লিয়ারেন্স দেয়। আর তাদের ক্লিয়ারেন্সের পরও যদি কোনো মালামাল আটক হয়, তা ছাড়িয়ে আনার দায়িত্বও লাইনম্যানদের। এ ক্ষেত্রে চোরাচালানির কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয় না। ওই মালামালের ক্রেতা বা মহাজনরাই এই টাকা দিয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতাও তাদের সরাসরি সহায়তা করেন বলে লাইনম্যানরা জানায়। অনুসন্ধানে চোরাচালানের নেটওয়ার্ক পরিচালনাকারী লাইনম্যানদের নেতা হিসেবে যারা রয়েছেন তারা হলো— তুহিন, ইসলাম, ফিরোজ, বিপ্লব, কালু, বাবু, শান্ত, সাগর, মাসুদ, নয়ন, ভাতিজা ফায়জুল, মান্নান, সেলিম, রাহাত, রোজ, রাজ, ফরিদ, ময়না, কুসুম, আনিসুর ও নয়ন কমিশনার।

রেলওয়ে রুট ইজারা : পার্বতীপুর জিআরপি থানার আওতাধীন সীমান্তবর্তী হিলি রেলওয়ে স্টেশনের ওপর দিয়ে আন্তঃনগর একতা, দ্রুতযান, রুপসা, সীমান্ত, বরেন্দ্র, নীল সাগর, তিতুমীর এক্সপ্রেস, উত্তরা মেইল, রকেট মেইলসহ কয়েকটি লোকাল ট্রেন প্রতিদিন চলাচল করে। ওইসব ট্রেনে ভারতীয় শাড়ি, লুঙ্গি, থান কাপড়, কসমেটিকস সামগ্রী, মসলাজাত দ্রব্য, সাবান, জুতা, বিয়ার, হেরোইন, প্যাথেডিন, মদ, গাঁজা, আপেল, আঙুর, কমলা, রাসায়নিক সার, লবণ, ওষুধসহ শতাধিক আইটেমের কোটি কোটি টাকার পণ্য চোরাকারবারিরা পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। চোরাচালানের জন্য মাসিক ৫০ হাজার টাকার চুক্তির ভিত্তিতেও ইজারা দেওয়া হয় সীমান্তবর্তী ৫০ কিলোমিটার রেলওয়ে রুটকে। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর