শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ট্রেনের চেইন স্মাগলারদের হাতে

স্টেশনের আগেই হঠাৎ বন্ধ

মির্জা মেহেদী তমাল, হিলি (দিনাজপুর) থেকে ফিরে

ট্রেনের চেইন স্মাগলারদের হাতে

হিলি স্টেশনের আগেই চেইন টেনে ট্রেন থামিয়ে দেওয়া হয়েছে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

গত মাসের ঘটনা। জয়পুরহাট থেকে ছেড়ে আসা আন্তনগর নীলসাগর এক্সপ্রেস সীমান্তবর্তী হিলি স্টেশন পার হতেই হঠাৎ থেমে গেল। রেললাইনের মাত্র কয়েক হাত দূরে সীমান্ত পিলার। পিলার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বিএসএফ সদস্য। ট্রেনটি থামার সঙ্গে সঙ্গে বিজিবি সদস্যরা ভীষণ তৎপর হয়ে ওঠেন। তারা ট্রেনের ভিতর কাউকে খুঁজছেন। জানা গেল, ট্রেনের ভিতরে থাকা চোরাকারবারিরা চেইন টেনে ট্রেন থামিয়ে দিয়েছে। মুহূর্তেই ওপারে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বড় কোনো চোরাকারবারি ট্রেনে উঠে পড়েছে। মিশে গেছে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে। তার খোঁজ মেলেনি। দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনের দৃশ্য এটি। সীমান্ত এলাকা ঘুরে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী হিলি স্টেশনে মাত্র তিনটি ট্রেনের যাত্রাবিরতির শিডিউল রয়েছে। আন্তনগর ট্রেন দাঁড়ানোর নিয়মই নেই। কিন্তু চোরাকারবারিরা শিকল টেনে প্রায় সব ট্রেনই আউটার সিগন্যালে থামিয়ে অবৈধ মালামাল পাচার করে। সীমান্ত এলাকায় ট্রেন চলে যায় চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণে। তখন তারা ইচ্ছামতো শিকল টেনে ট্রেন থামায়।

সরেজমিন দেখা যায়, চোরাকারবারিরা রেললাইন ঘেঁষা সীমান্ত পেরিয়ে ট্রেনে যাতে না উঠতে পারে সেজন্য হিলি স্টেশন থেকে বিরামপুরের দিকে রেললাইনের পাশে বেশ কয়েকটি বিজিবি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিজিবি পুরো স্টেশন এলাকা সিসিটিভির আওতায় নিয়েছে। তার পরও চোরাকারবারিদের ঠেকানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোরাচালান পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রেন ‘ইজারা’ দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি)। আর এদের সহায়তা করেন রেলওয়ে, থানা ও অভিবাসন পুলিশের কিছু সদস্য। এ ছাড়া সীমান্ত ঘেঁষা রেললাইনেরও ইজারা দেওয়া হয়। ৪০ চোরাকারবারি এই ট্রেনে মালামাল বহনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। ট্রেনের যাত্রীরা তাদের কাছে জিম্মি। চোরাকারবারিরা যাত্রীদের বসার সিটের ওপর-নিচে, টয়লেটসহ গোটা ট্রেনে মালামাল তুলে দেয়। অনেক সময় যাত্রীদের গায়ে, পায়ের ওপর মালামাল জোর করে রাখা হয়। কিছু বলতে গেলেই যাত্রীদের সঙ্গে চোরাকারবারিদের বাকবিতণ্ডা, এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। কখনো কোনো যাত্রী চোরাচালানে বাধা দিলে তাকে রেলওয়ে পুলিশের সহায়তায় শায়েস্তা করা হয়। এতে একদিকে যেমন যাত্রীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে চোরাচালানকে করা হচ্ছে উৎসাহিত। জয়পুরহাট শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত চেকপোস্ট। বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য এখানে গড়ে উঠেছে স্থলবন্দর। প্রতিদিন এই চেকপোস্ট দিয়ে বৈধ-অবৈধভাবে পণ্য আনা-নেওয়া হচ্ছে। যেগুলো ট্রেনের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, এ সীমান্ত দিয়ে বৈধতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পণ্য প্রবেশ করে অবৈধভাবে। আসছে মাদক, অস্ত্র থেকে শুরু করে ওষুধ, কাপড়, মসলাসহ যাবতীয় পণ্য। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এখানকার চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেট খুবই শক্তিশালী।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হিলি স্টেশনে শত শত নারী-পুরুষ পিঠে ও পেটে ভারতীয় মালামাল নিয়ে আন্তনগর ট্রেনে উঠে পড়ে। দূরে দাঁড়িয়ে পুলিশ সেই দৃশ্য দেখে।

জানা যায়, হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট থেকে ভারতের হাঁড়িপুকুর গ্রাম পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় শূন্যরেখা থেকে ৫-১০ গজের মধ্যে রেললাইন রয়েছে। এসব এলাকা দিয়ে পাচার করে আনা ভারতীয় মালামাল রেল কর্মচারী, রেলপুলিশ ও পুলিশের সহযোগিতায় সহজেই ট্রেনে পাচার করা হয়। চোরাকারবারিরা পোড়াদহ, চুয়াডাঙ্গা, ঈশ্বরদী, নাটোর, সান্তাহার, জয়পুরহাট, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী এবং বিরামপুর থেকে ট্রেনযোগে এসে আটাপাড়া, হিলি বিওপি ও হিলিসিপির সুবিধামতো সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। চোরাকারবারিরা ভারতীয় এসব পণ্য কিনে সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করে। পরে বিভিন্ন সংস্থার লাইনম্যানের সহযোগিতায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং মালামাল ট্রেনে ওঠায়। এর বিনিময়ে রেলওয়ের লাইনম্যানরা চোরাই পণ্য অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে টোল আদায় করেন। সূত্র জানায়, চোরাকারবারিরা বিভিন্ন এলাকা থেকে এলেও তারা হিলি এলাকার চোরাকারবারি নিয়ন্ত্রক ও দাদন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। টোকাই শ্রেণির চোরাকারবারিরা নিয়ন্ত্রক ও দাদন ব্যবসায়ীদের অর্থে চোরাই পণ্য কেনে এবং তাদের কাছেই বিক্রি করে। বিনিময়ে তারা মালামাল পাচারের নিরাপত্তাসহ অল্প লভ্যাংশ পায়। এ ছাড়া হিজড়াদের একটি চোরাকারবারি দল রয়েছে, তারা নিয়মিত ট্রেনে ভারতের চোরাই পণ্য বহন করে। পার্বতীপুর জিআরপি থানার কাছ থেকে ট্রেন নেওয়া এবং চোরাকারবারিদের দাদন ব্যবসায়ীর দুটি চক্র রয়েছে। তারা হলেন বর্তমান ‘ইজারাদার’ সুজাত আলী এবং তার সহযোগী শামীম আলী ও খতিবর। এর আগে ট্রেন ‘ইজারা’ নিতেন আবদুল মান্নান এবং তার সহযোগী মোশাররফ হোসেন ও পিচ্চি কালাম। যে কোনো ট্রেনে চোরাই পণ্য এলে পার্বতীপুর থানা, রেলওয়ে পুলিশ, আরএসবি পুলিশ, কাস্টমস ও গোয়েন্দা পুলিশের জন্য টাকা তোলা হয়। ট্রেনের চোরাই পণ্য থেকে তার লোক নেছার আলী চাঁদা তোলেন। পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে ট্রেনে নেওয়া চোরাই পণ্যের গুদাম রয়েছে। পার্বতীপুর রেলস্টেশনের পাশে একটি গুদামে এসব মালামাল রাখে বলে সূত্র জানায়। হাকিমপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুস সবুর জানান, ‘আগের চেয়ে এখানকার পরিস্থিতি অনেক ভালো। মিলেমিশে সবাই কাজ করছে। যারা চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রতিনিয়ত গ্রেফতার করা হচ্ছে। চোরাচালান রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর