শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

মধ্যরাতে সরানো হলো সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য

বিক্ষোভ সংঘর্ষ, পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা, রমজানকে ঘিরে অনেকে বলছেন ইতিবাচক

নিজস্ব প্রতিবেদক

মধ্যরাতে সরানো হলো সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য

সরিয়ে ফেলা হয়েছে ভাস্কর্য। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে গতকাল জলকামান ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ —জয়ীতা রায়

ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনগুলোর দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত ভাস্কর্যটি। বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্যরাতে শুরু করে ভোরের আগেই ভাস্কর্যটি সরানোর কাজ শেষ হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশমুখ থেকে সরিয়ে কাপড় মুড়িয়ে এটি এখন রাখা হয়েছে পাশেই এনেক্স ভবনের সামনে। এ নিয়ে গতকাল সারা দিন দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল। প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে ঢাকায়। কাঁদুনে গ্যাস ও জলকামান ছুড়ে মিছিল ও বিক্ষোভ পণ্ড করে দিয়েছে পুলিশ। আজ সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই ভাস্কর্য সরানোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ গড়ার উদ্যোগ ভূলুণ্ঠিত হলো। আবার অনেকেই আসন্ন রমজানকে ঘিরে অস্থিরতা সৃষ্টির শঙ্কা থেকে ভাস্কর্য সরানোর প্রতিক্রিয়াকে ইতিবাচক বলছেন। ঠিক কার বা কাদের নির্দেশে ভাস্কর্যটি সরানো হলো, সে বিষয়ে স্পষ্ট ভাষ্য পাওয়া যায়নি। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা প্রধান বিচারপতির নির্দেশের কথা বলেছেন একই সুরে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ ভাস্কর্যটি অপসারণের পদক্ষেপ নিয়েছে। ভাস্কর্যটির শিল্পী মৃণাল হক বলেছেন, ‘চাপের মুখে’ এটি সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তবে কারা চাপ দিয়েছেন সে বিষয়ে মুখ খোলেননি। শুধু বলেছেন, ভাস্কর্যটি যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য অপসারণের সময় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’-এর আদলে এই ভাস্কর্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হলে হেফাজতসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন তার বিরোধিতায় নামে। হেফাজত এই ভাস্কর্য সরানোর দাবি জানিয়ে সরকারকে ৫ মে মতিঝিলে ফের সমাবেশের হুমকি দেয়। ওলামা লীগও তা অপসারণের দাবি জানায়। এরপর ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন একদল ওলামার সঙ্গে গণভবনে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরাতে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে যুক্তি হিসেবে এর নান্দনিক ‘ত্রুটির’ পাশাপাশি জাতীয় ঈদগাহর কাছে অবস্থানের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। গ্রিক দেবীকে শাড়ি পরানো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। ভাস্কর্য অপসারণে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পর রোজার আগেই তা সরানোর দাবি জানিয়ে হরতালের হুমকি দিচ্ছিল ইসলামী সংগঠনগুলো। এমন প্রেক্ষাপটেই রোজা শুরুর তিন দিন আগে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আকস্মিকভাবে একদল শ্রমিককে ভাস্কর্যটি অপসারণের কাজ শুরু করতে দেখা যায়। সুপ্রিম কোর্টের ফটক তালাবদ্ধ থাকায় বাইরে থেকে শুধু দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ছিল না সাংবাদিকদের। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ‘আদালতের বিষয়’ বলে এড়িয়ে যান। শ্রমিকরা যখন কাজ করছিলেন, তখন একটি ছোট ট্রাক ও গাড়ি পাশে ছিল। কিছু সময় পর ভাস্কর্যটির শিল্পী মৃণাল হককেও সেখানে দেখা যায়। ভাস্কর্য অপসারণের খবর প্রকাশের পর রাত ২টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনের রাস্তায় সমবেত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন গণজাগরণ মঞ্চের একদল কর্মী। পরে ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতা-কর্মীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। ন্যায়বিচারের প্রতীক এই ভাস্কর্য আদালত প্রাঙ্গণ থেকে অপসারণের প্রতিবাদ জানান তারা। এক পর্যায়ে তারা সুপ্রিম কোর্টের ফটকে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে রাত ৩টার দিকে ভাস্কর্য সরানোর কাজ কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে আশপাশের বাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ভোররাত ৪টার দিকে ভাস্কর্যটি ক্রেনের সাহায্যে ট্রাকে তুলে নেওয়া হয়। ভাস্কর মৃণাল হক বলেন, ‘আমি কিছু জানি না, উপরের প্রেসারে সরাতে হচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে সরাতে, চাপ দেওয়া হয়েছে।’ কারা চাপ দিয়েছেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকের অনেক রকম ক্ষমতা আছে। আমি বানিয়েছিলাম, আমাকে সরাতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমার হাত-মুখ বাঁধা। মাফ চাই, আমি কিছু বলতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘ভাস্কর্যটি সরিয়ে সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের পাশে কোথাও বসানো হতে পারে।’ এক হাতে তলোয়ার ও অন্য হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরা নারীর ভাস্কর্যটির বিষয়ে মৃণাল হক বলেন, ‘গ্রিক দেবী ঠিক নয়, বলাও ঠিক হবে না। এটা গ্রিক ভাস্কর্য নয়, একটা বাঙালি মেয়ে, শাড়ি-ব্লাউজ পরা। গ্রিক হলে সেখানে মেজকি থাকত। ভুল জিনিস মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।’ এর আগে কয়েকটি ইসলামী দলের দাবির মুখে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বিমানবন্দরের সামনে থেকে লালনের ভাস্কর্য অপসারণের প্রসঙ্গ তুলে মৃণাল বলেন, ‘এরপর হয়তো অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য ও শেরাটনের সামনের ঘোড়ার গাড়ির ভাস্কর্য সরানোর নির্দেশ আসবে।’ ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে বিক্ষোভকারী তানভীর রুসমত বলেন, ‘এই ভাস্কর্য ন্যায়বিচারের প্রতীক। মৌলবাদীদের দাবির মুখে এটা সরানো যায় না।’ সুপ্রিম কোর্টে এই ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, ‘সরকার মৌলবাদী হেফাজতের সঙ্গে আপস করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের শক্তি দেশের সাধারণ মানুষ ভাস্কর্যটি পুনরায় স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন করবে।’ ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনের দাবিতে গতকাল বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট অভিমুখে যাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা দেন তিনি। সবাইকে এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বানও জানান। মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘এ তো বিরাট আপসকামিতার রাজনীতি। আওয়ামী লীগ যে মৌলবাদীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তার একটা অংশ হিসেবে এটা হলো। শুধু তো এটা নয়, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এবং তাদের অন্যান্য দাবির প্রতি আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তারা নিজেরাও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কথা বলছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোনো না কোনো কারণে তারা একেবারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী যেই চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপগুলো রয়েছে, তার সঙ্গে একটা আপস করে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘নারীর হাতে ন্যায়বিচারের একটা দায়িত্ব, একটা ক্ষমতা কিংবা নারী যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, অনেক বিষয় এটার সঙ্গে ছিল। একটা মৌলবাদী গোষ্ঠী ভাস্কর্যটি সরানোর দাবি তুলেছে এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তাদের দাবির সঙ্গে তিনিও একমত। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এবং মৌলবাদীদের যে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এটা সরানো হলো এর পেছনে রক্ষণশীলতা, পশ্চাত্গামিতা, এগুলোর সঙ্গে একটা আপসের অংশ হিসেবেই পুরো বিষয়টিকে দেখছি।’

পুলিশের বাধায় বিক্ষোভ পণ্ড, আহত ২৫, আটক ৪ : ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে গতকাল বাম ছাত্র সংগঠনগুলো প্রগতিশীল ছাত্র জোটের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে কাঁদুনে গ্যাস ও জলকামান ছুড়ে পণ্ড করে দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন ছাত্র জোটের নেতারা। বিক্ষোভকালে তাদের ওপর রাবার বুলেটও নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দিকে যাওয়ার পথে হাই কোর্ট মাজার গেটের সামনে এসব ঘটনা ঘটে। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, ঢাকা কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মোর্শেদ হালিম, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আরিফ নূর ও লালবাগ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী রাফিন জয়কে আটক করে পুলিশ। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আটক করে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সমাবেশ শেষে সুপ্রিম কোর্ট অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন প্রগতিশীল ছাত্র জোটের নেতারা। রাজু ভাস্কর্য থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে হাই কোর্ট মোড়ে পৌঁছার আগেই পুলিশি ব্যারিকেডের মুখে পড়ে মিছিলটি। এ সময় বিক্ষুব্ধরা ব্যারিকেড টপকিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের ওপর জলকামান দিয়ে রঙিন পানি ও কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে মারে। এতে অন্তত ২৫ জন আহত হলে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

শুকরিয়া মিছিল : এদিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে মূর্তি সরানোর ঘটনায় জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে শুকরিয়া মিছিল করেছে হেফাজতে ইসলাম। মিছিল শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান হেফাজত নেতা-কর্মীরা। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘায়ু কামনা করে মোনাজাত করেন তারা। হেফাজতের ঢাকা মহানগরী সভাপতি মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দেশের সব মূর্তি অপসারণের দাবি জানিয়েছি। সেই সঙ্গে আর কোথাও যেন এভাবে মূর্তি স্থাপন করা না হয়, সে দাবিও জানিয়েছি।’

সর্বশেষ খবর