রবিবার, ২৮ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুই পারে দুই মাফিয়া

এপারে মনতাজ ওপারে সমীর

মির্জা মেহেদী তমাল, দিনাজপুর (হিলি) থেকে ফিরে

দুই পারে দুই মাফিয়া

দেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা স্টেশন হিলি। হিলিকে টার্গেট করেই গড়ে উঠেছে শক্তিশালী চোরাচালান মাফিয়া সিন্ডিকেট। এপারে আছেন মনতাজ আর ওপারে সমীর। এই দুই মাফিয়া নিয়ন্ত্রণ করছেন দুই পারের চোরাচালান। শক্তিমান এই দুই মাফিয়ার কথার বাইরে কোনো পণ্যই এপার-ওপার হয় না। অস্ত্র, মাদকসহ অন্যান্য পণ্য চোরাচালানের নিয়ন্ত্রক তারাই। তাদের কথাই সেখানে শেষ কথা। স্টেশন, ট্রেন আর রেলপথ কারা ইজারা নেবে— এই দুই মাফিয়াই ঠিক করে দেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হিলির মনতাজ মূলত সোনা পাচারকারী। অঢেল সম্পদের মালিক এই মনতাজ এপারের পুরো চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। ওপারে বালুর মাঠ জেলার হিলিতে চোরাচালান মাফিয়া সমীর নিয়ন্ত্রণ করছেন সেখানকার চোরাচালান। রয়েছে তার ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট। গাড়ির ব্যবসাও করেন তিনি। ওই যানবাহনে করে চোরাই পণ্য ঢুকে যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। অত্যন্ত প্রভাবশালী সমীরের কথার ওপর ওপারে প্রশাসনের কেউ কথাও বলেন না। সেখানে রয়েছে তার ২১ জনের সিন্ডিকেট। এই ২১ জনের আবার এক একটি করে উপদল রয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরই কাজ চোরাচালান। সমীর ওপারের প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে রিং লিডার হিসেবে নিজেকে ধরে রেখেছেন। সূত্র জানায়, এই দুই মফিয়া জয়পুরহাট ও হিলিকে চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও শুধু হাকিমপুর, পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট সদর থানার প্রতিদিনের স্লিপ বাণিজ্য ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া জয়পুরহাট ও হিলির আশপাশের ৩০টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন আক্কেলপুর, কালাই, ক্ষেতলাল, বিরামপুর, ফুলবাড়ী, শিবগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জ থানা এবং র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও জিআরপি থানা মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিকেও নিয়মিত মাসোহারা দিতে হয়। দুই মাফিয়ার লোকজন এতটাই ভয়ঙ্কর যে, প্রশাসনের চোখের সামনে চলন্ত মেইল ও আন্তনগর ট্রেনের ভ্যাকুয়াম খুলে দেন। হিলি স্টেশনে স্টপেজ না থাকলেও স্টেশনের কয়েক শ গজ দূরে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে আন্তনগর ট্রেন। ১৫-২০ মিনিট ধরে ট্রেন থামিয়ে বগিতে তোলা হয় চোরাই পণ্য। সূত্র জানায়, চোরাকারবারিরা ভারত থেকে এখন বাংলাদেশে আনছেন ভেজাল ও নকল সার (পটাশ ও ডিএপি), কাপড়, চিনি, গরম মসলা, চাল, পিয়াজ, লবণ, চিনি, ধান ও পাটের বীজ, ডাল, নতুন ও চোরাই মোটরসাইকেল, কসমেটিকস, ইমিটেশনের গয়না, গার্মেন্টসামগ্রী, যৌন উত্তেজক বড়ি, নেশার ইনজেকশন, ইয়াবা ও ফেনসিডিল। আরও আনছেন অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকদ্রব্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে মাছের পোনা, তামা, পিতল, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, ইলিশ মাছ, বেনসন সিগারেট, সুপারি, গার্মেন্টসামগ্রী (বিশেষ করে জিনসের) ইট ও পাট। আর এসব মালামাল পারাপার করতে হলে দুই পারেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের বিভিন্ন হারে টাকা দিতে হয়। এ টাকা আদায় করার জন্য আছে লাইনম্যান ও কালেক্টর।

মনতাজ সিন্ডিকেট : গোটা উত্তরের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন হিলির মনতাজ। সোনা ব্যবসায়ী এই মাফিয়ার সিন্ডিকেটে রয়েছে অস্ত্র, মাদক ও সোনা ব্যবসায়ী। এ ছাড়া আছে অন্য পণ্য এপার-ওপার করার সিন্ডিকেট। পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলেন ইদ্রিস আলী মিঠু, হিলি হাকিমপুর উপজেলার চুড়িপট্টি গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে গিয়াসউদ্দিন, নয়াপাড়া গ্রামের মৃত আবদুল হামিদের ছেলে মাহমুদুল ইসলাম। দক্ষিণ বাসুদেবপুর মহিলা কলেজপাড়ার নূর ইসলাম, নবাবগঞ্জ উপজেলার জাকিহাড় গ্রামের আবদুর রহমান, হিলি হাকিমপুর উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের রায়হান হাকিম। সিপি রোড গ্রামের টগর মল্লিক। তিনি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। হিলি হাকিমপুর উপজেলার ফকিরপাড়া ধরদা গ্রামের সোহরাব হোসেন। বিরলের আলমগীর মিয়া, মোকারম হোসেন, নুনিয়া শাহপাড়া গ্রামের বজলুর রহমান কালু, ক্যাম্পপাড়া বনগাঁও গ্রামের নূর ইসলাম, হাকিমপুর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের শরিফুল ইসলাম, দাঙ্গাপাড়া গ্রামের হুমায়ুন কবির। বিরল উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের আলম, কারুলিয়া গ্রামের মোকাররম হোসেন, সাজ্জাদ হোসেন, রামসাগর গ্রামের মিজানুর রহমান, সদর উপজেলার মহরমপুর গ্রামের সেরেকুল, হাকিমপুর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের আকরাম মাস্টার, হাঁড়িপুকুর গ্রামের তোজাম্মেল হক। এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিলি দক্ষিণ দিনাজপুরের পূর্ব আফতইর গ্রামের আতিয়ার রহমান, ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের ভারতহিলি থানার হাঁড়িপুকুর গ্রামের নাজির হোসেন, মাহবুবুল ইসলাম, বিরলের বনগাঁও, ক্যাম্পপাড়া গ্রামের আলমগীর মিয়া, মহরমপুর গ্রামের আবদুস সাত্তার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চক্রে আরও রয়েছেন চন্দন, অবসর চৌধুরী, আঙ্গুর, সাবু, মোস্তাক ওরফে মাদক মোস্তাক, রণি, চিনি ইসলাম, নীলমণি ও বুলেট। নন্দলাল পার্সি বলে আরেকজনের নাম শোনা গেলেও তার ব্যাপারে জোরালো কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে এরা প্রত্যেকেই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। অথচ কয়েক বছর আগেও এদের কয়েকজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী বা ছিঁচকে সন্ত্রাসী। হিলি স্টেশন এলাকার কামাল, জামাল, হযরত, শাহিন ও টগর মল্লিক। হিলি স্টেশনপট্টির কামাল হোসেন, রায়হান, মাহে আলম, মাঠপাড়ার জাহাঙ্গীর আলম, ভারতের হাঁড়িপুকুরের আতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, নাজির উদ্দীন, শাহাবুল ও বেলাল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর