সোমবার, ২৯ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

সীমান্তে হাত বাড়ালেই অস্ত্র

মির্জা মেহেদী তমাল, দিনাজপুর থেকে ফিরে

সীমান্তে হাত বাড়ালেই অস্ত্র

রিভলবার আর পিস্তল ১০-১৫ হাজার টাকা। শটগান ৩০ হাজার। তবে সংখ্যা ১০ এর নিচে হলে এ দাম বেড়ে যাবে। বেশি দামের অস্ত্রও আছে। দাম দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। দেশের উত্তর সীমান্তের ওপারে ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে এমন দামের অস্ত্র মিলছে। আর এ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা দিনে গড়ে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি অস্ত্র দেশের অভ্যন্তরে পাচার করছে। বাংলাদেশের অস্ত্র ক্রেতারা এদের কাছ থেকেই অস্ত্র জোগাড় করছে। দিনাজপুর ও জয়পুরহাটের সীমান্ত এলাকা ঘুরে বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য মিলেছে। সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, পাবনা ও ফরিদপুর এলাকায় অস্ত্রের ক্রেতা বেশি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিরাও তাদের কাছ থেকে নিয়মিত অস্ত্র কিনছে। সীমান্তের ওপারে বালুরঘাটের  হাঁড়িপুকুরকে অবৈধ অস্ত্র বিকিকিনির হাট বলা হয়ে থাকে। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মিলনমেলাও বলা যেতে পারে এ এলাকাকে। বিভিন্ন ধরনের অবৈধ অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে এ এলাকায়। বাংলাদেশের দিনাজপুর অঞ্চলে ২০ জন অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী ও গডফাদার সক্রিয়। দিনাজপুরের হাকিমপুর থানা এলাকার নওপাড়া, রায়ভাগ, নন্দীপুর আর মংলা ঘাসুদিয়া দিয়ে অবাধে যাতায়াত করা যায় হাঁড়িপুকুরে। হাঁড়িপুকুর একটি গ্রাম হলেও এর মালিক বাংলাদেশও। দুই দেশের এক গ্রাম বলা হয় এই গ্রামটিকে। যে কারণে বিজিবির চোখ এড়িয়ে বা হাঁড়িপুকুরে স্থানীয় কোনো লোকের পরিচয় সূত্র ধরে ওই গ্রামে যাওয়া যায়। হাঁড়িপুকুর মসজিদ ঘাটে বা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কিংবা গলির মাথার মুদি দোকানটিতে বসে বাংলাদেশের দিকে তাকালেই দেখা যায়, থেকে থেকে দলে দলে আসছে মানুষ। কোনো দলে চারজন, কোনো দলে সাত থেকে আটজন। অনেকে ওপারে মোটরসাইকেল রেখে চলে আসছে এপারে। এপার থেকেও একইভাবে যাচ্ছে ওপারে। কে বাংলাদেশি আর কে ভারতীয়, বোঝার কোনো উপায় নেই। সূত্র জানায়, প্রতিটি অস্ত্র বিক্রি করে তার লাভ থাকে তিন থেকে চার হাজার টাকা। জার্মানির রিভলভার ও পিস্তল বলা হলেও মূলত এগুলো ভারতীয় এবং বেশ উন্নতমানের। সচরাচর ছিনতাইকারীদের কাছ থেকেই বিক্রেতারা আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে। অস্ত্র রাখার অর্ধশতাধিক বাড়ি আছে হাঁড়িপুকুর এলাকায়। হাঁড়িপুকুরে ঢুকলেই প্রথমে মনে হবে গ্রাম এলাকার ছোট কোনো বাজারে ঢুকছি। অধিকাংশ ঘরবাড়ি মাটির। প্রতিটি ঘরে-বারান্দায় দোকান। বারান্দায় ভারতীয় থ্রি-পিস, শাড়ি আর প্রসাধনের পসরা। আর ঘরগুলো ব্যবহার হচ্ছে ‘মিনি বার’ হিসেবে। হাঁড়িপুকুরে এ ধরনের বার আছে ৩৫টির মতো। ভিতরে ঢুকে দেখা যায়, অবাধে মদ আর ফেনসিডিল খাওয়ার দৃশ্য। গাঁজা আর হেরোইনও চলছে। বিএসএফের সদস্যরাও এসে দোকানে বসে চা খাচ্ছে। এসব ঘরেরই বেশ কয়েকটিতে আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনা হয়। তবে তা খুবই সতর্কতার সঙ্গে। যে কোনো খদ্দেরের কাছে তারা যে কোনো পণ্য বিক্রি করবে। কিন্তু চেনা খদ্দের ছাড়া অস্ত্র বেচাকেনা নিয়ে কোনো আলোচনাই করবে না। সাফ জানিয়ে দেবে, এখানে এসব চলে না। স্থানীয় গোয়েন্দা সূত্রমতে, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি সীমান্ত এলাকার কোরিয়া, হাটখোলা, চেচড়া, আটাপাড়া, বাগজানা স্টেশন, সদর থানার, জয়পুরহাট সদরের আমদই, পাগলা দেওয়ান, ধলাহার, চকবরকত, রতনপুর ও শালপাড়া এবং দিনাজপুরের হিলির আটাপাড়া, স্টেশন, ফকিরপাড়া, চুরিপট্টি, ফুটবল মাঠ, ডাববাগান ও বালুর মাঠ এলাকায় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একাধিক চক্র আছে। সূত্র জানায়, অস্ত্র চোরাচালানিরা বিয়ের গাড়ি আর বর-কনে সাজিয়ে সেই গাড়িতে করে অস্ত্র চোরাচালান করে। এই গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেলসহ আরও কয়েকটি গাড়ির বহরও থাকে। আবার জীবিত কাউকে লাশ সাজিয়ে কফিনের ভিতরেও অস্ত্র চোরাচালান হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এ ধরনের ঘটনা ধরাও পড়েছে।

তালিকাভুক্ত ২০ অস্ত্র ব্যবসায়ী : হিলি হাকিমপুর উপজেলার চুড়িপট্টি গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে গিয়াসউদ্দিন, নয়াপাড়া গ্রামের মৃত আবদুল হামিদের ছেলে মাহমুদুল ইসলাম, দক্ষিণ বাসুদেবপুর মহিলা কলেজপাড়ার নূর ইসলাম, নবাবগঞ্জ উপজেলার জাকিহাড় গ্রামের আবদুর রহমান, হিলি হাকিমপুর উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের রায়হান হাকিম, সিপি রোড গ্রামের টগর মল্লিক। তিনি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। হিলি হাকিমপুর উপজেলার ফকিরপাড়া ধরদা গ্রামের সোহরাব হোসেন, বিরলের আলমগীর মিয়া, মোকারম হোসেন, নুনিয়া শাহপাড়া গ্রামের বজলুর রহমান কালু, ক্যাম্পপাড়া বনগাঁও গ্রামের নূর ইসলাম, হাকিমপুর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের শরিফুল ইসলাম, দাঙ্গাপাড়া গ্রামের হুমায়ুন কবির, বিরল উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের আলম, কারুলিয়া গ্রামের মোকাররম হোসেন, সাজ্জাদ হোসেন, রামসাগর গ্রামের মিজানুর রহমান, সদর উপজেলার মহরমপুর গ্রামের সেরেকুল, হাকিমপুর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের আকরাম মাস্টার, হাঁড়িপুকুর গ্রামের তোজাম্মেল হক। এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিলি দক্ষিণ দিনাজপুরের পূর্ব আফতইর গ্রামের আতিয়ার রহমান, ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের ভারত হিলি থানার হাঁড়িপুকুর গ্রামের নাজির হোসেন, মাহবুবুল ইসলাম, বিরলের বনগাঁও, ক্যাম্পপাড়া গ্রামের আলমগীর মিয়া, মহরমপুর গ্রামের আবদুস সাত্তার।

সর্বশেষ খবর