মঙ্গলবার, ৩০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ড্রইং রুম বাংলাদেশে বেডরুম ভারতে

মির্জা মেহেদী তমাল, দিনাজপুর (হিলি) থেকে ফিরে

ড্রইং রুম বাংলাদেশে বেডরুম ভারতে

হিলি হাড়িপুকুর গ্রামের এই ঘরটির অর্ধেক বাংলাদেশে বাকিটা ভারতে। সাদা দাগ দিয়ে চিহ্নিত হয়েছে দুই দেশের সীমানা (বামে)। ডানে আরেকটি বাড়ির মধ্যে সীমানা পতাকা

পাড়ার অর্ধেক বাংলাদেশের বাঘমারা। অন্যটা ভারতের হাঁড়িপুকুর। কিন্তু দুই পাড়ার মাটি, মানুষ, ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি এক। আজও একটি পাড়ার দুটি দেশ। স্থানীয়দের কারও ড্রইংরুম বাংলাদেশে, বেডরুম ভারতে। গ্রামের একমাত্র মসজিদটি পড়েছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। এ মসজিদে যেতে হয় ভারতের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। পূর্ব-দক্ষিণ ভারতের। মসজিদের দরজাটি পূর্বমুখী এবং সেটি ভারতীয় অংশে। ভারতের মাটি মাড়িয়ে বাংলাদেশিরা নামাজ আদায় করতে যান মসজিদে। দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর থেকে মাত্র অর্ধ কিলোমিটার উত্তরেই এই সীমান্ত গ্রাম। গ্রামের মাঝপথে রয়েছে চিহ্নিত কয়েকটি সীমানা পিলার। আবার কোথাও সাদা রং দিয়ে দুই দেশের সীমানা ভাগ করে দেখানো হয়েছে। হাঁড়িপুকুর গ্রামটি ঘুরে দেখা গেছে, বাংলাদেশি মহিলারা দিন শেষে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ভারতে যান। ভারতীয় যুবকরা পান চিবোতে চিবোতে বাংলাদেশে এসে আড্ডা দেন। ঈদ এলে দুই গ্রামের বাসিন্দারা একত্রে উৎসব পালন করেন। পক্ষান্তরে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব এলেও উভয় গ্রামের বাসিন্দারা উৎসব পালন করেন। গোটা গ্রামে বসবাস করে ১৯৮টি পরিবার। এর মধ্যে ৪টি পরিবার সনাতন ধর্মাবলম্বী। বাকিরা ইসলাম ধর্মের। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এই গ্রামের এক তৃতীয়াংশ পড়ে বাংলাদেশে, বাকিটা (হাঁড়িপুকুর) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশের হাঁড়িপুুকুর গ্রাম দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদাড় ইউনিয়নের অন্তর্গত। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি থানার অন্তর্গত বাগমারা গ্রাম। এভাবে গ্রামটিকে ভাগ করে দেওয়া হলেও গ্রামবাসীকে ভাগ করা যায়নি। দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার নওপাড়া, রায়ভাগ, নন্দীপুর আর মংলা ঘাসুদিয়া দিয়ে অবাধে যাতায়াত করা যায় হাঁড়িপুকুরে। দুই দেশের এক গ্রাম বলা হয় এই গ্রামটিকে। যে কারণে বিজিবির চোখ এড়িয়ে বা হাঁড়িপুকুরে স্থানীয় কোনো লোকের পরিচয়সূত্র ধরে ওই গ্রামে যাওয়া যাচ্ছে অনায়াসে।

হাঁড়িপুকুর মসজিদ ঘাটে বা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কিংবা গলির মাথার মুদি দোকানটিতে বসে বাংলাদেশের দিকে তাকালেই দেখা যায়, থেকে থেকে, দলে দলে আসছে মানুষ। কে বাংলাদেশি আর কে ভারতীয়, বোঝার কোনো উপায় নেই। গ্রামে কোনো আবাদের কাজ হয় না। মাছ চাষ ও পশু পালনের প্রচলনও তেমন দেখা যায় না। গ্রামবাসীর একমাত্র পেশা চোরাচালান। সমগ্র গ্রামটি যেন চোরাচালান পণ্যের একটা বৃহৎ আড়ত। ভারতীয় পরিচয় নিয়ে তারা স্বচ্ছন্দে ভারতের যে কোনো স্থানে চলে যেতে পারেন বিনা বাধায় এবং শাড়িকাপড়, মসলা, প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে গ্রামে ফিরে আসতে পারেন। আবার বাংলাদেশি পরিচয়ে তারা বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে যাতায়াত করেন স্বচ্ছন্দে।

কথা হয় বৃদ্ধ মহিতোষ বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মনে আছে ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে ওই যে দেখছ হিলি স্টেশন, ওখান থেকেই ট্রেনে চড়ে বেশ কবার শেয়ালদহ গিয়েছি। সকাল ৭টায় ট্রেন ছিল। বাবা কতবারই না কলকাতা গিয়ে বাজার করে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন, রানাঘাট-দর্শনা হয়ে পদ্মা পেরিয়ে রাজশাহী হয়ে এই দিনাজপুরের হিলি। তখন তো আর এত জোরের ট্রেন চলত না। তবু ৬-৭ ঘণ্টার মাঝেই কলকাতা চলে যাওয়া যেত। আবারও যদি চলত দার্জিলিং ও আসাম মেইল, বেঁচে থাকতেই আর একবার না হয় চড়তাম।’

এভাবেই চলে আসছে ৬৬ বছর ধরে। এপারেও হিলি, ওপারেও হিলি। পান-বিড়ি দোকানি বললেন, ‘সন্ধ্যে হলেই এখানে শুরু হয় হরেক রকম ব্যবসা। এখানে পাবেন নেশাসামগ্রী, আগ্নেয়াস্ত্র, ভারতীয় শাড়িসহ নানারকম প্রসাধন সামগ্রী ও পণ্য। এ ছাড়া বসে মাদক বিক্রির হাট। আরও বসে চোরাকারবারিদের হাটবাজার। বসে থাকেন লাইনম্যান নামক সিন্ডিকেট সদস্যরা। সীমান্তরক্ষীদের টাকা না দিলেও সিন্ডিকেটকে দিতেই হয় টাকা।’

গ্রামের একমাত্র গোরস্থানটি ভারতীয় অংশে। সেখানে দাফনের কাজ হচ্ছে বাংলাদেশিদেরও।

তা ছাড়া এ গ্রামে অভিযান চালানোর ব্যাপারে বিধিনিষেধ টেনে রেখেছে সীমান্ত আইন। এ আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী সীমান্ত রেখার উভয় পাশে ১৫০ গজ করে ভূমি নো-ম্যান্স-ল্যান্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। কোনো দেশের সামরিক বা বেসামরিক ব্যক্তি নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে অবস্থান নিতে এর ওপর দিয়ে চলাফেরা করতে বা এখানে কোনো কিছু নির্মাণ করতে পারবে না। সংজ্ঞা অনুযায়ী বাগমারা গ্রামের ভারতীয় এবং বাংলাদেশ হাঁড়িপুকুর অংশের পুরোটাই নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে। ফলে ওই গ্রামের ভারতীয় অংশে যেমন বিএসএফ প্রবেশ করতে পারে না, তেমনি বিজিবি ঢুকতে পারে না বাংলাদেশের অংশে; যে কারণে ওই গ্রামে নির্ভয়ে চোরাকারবারিদের আড়ত গড়ে উঠেছে। ভারত ও বাংলাদেশের কোনো বাধা না থাকায় চোরাকারবারিদের অন্যতম নেটওয়ার্ক হিসেবে গড়ে উঠেছে ওই গ্রামটি। স্থানীয়রা জানান, অবস্থানগত কারণে ওই গ্রামটি হয়ে উঠেছে চোরাচালান প্রক্রিয়ার অভয়ারণ্য।

সর্বশেষ খবর