মঙ্গলবার, ৩০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজকুমারের দুধ সাগরে ননীর পর্বত!

গোলাম মাওলা রনি

রাজকুমারের দুধ সাগরে ননীর পর্বত!

রাষ্ট্রীয় অর্থের লুটপাট এবং ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে উচ্চ মার্গের তাত্ত্বিক অথচ রসঘন আলোচনা চলছিল। আলোচকবৃন্দ তাদের জ্ঞান-গরিমার সর্বোচ্চ শান ও মান ব্যবহার করে অঙ্ক কষে বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন যে, আবহমান বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন কোন খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয় এবং তা কেন ও কী কারণে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ে। তারা ২০১৬ সালে পাচার হয়ে গেছে বলে বিশ্বের গণমাধ্যমের টাটকা খবর ছিয়াত্তর হাজার কোটি টাকার আদি ও আসল উৎস এবং হালনাগাদ গন্তব্য ও অবস্থান সম্পর্কে নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করছিলেন। অন্যদিকে বিগত আট বছরে পাচার হয়েছে বলে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সাত লাখ কোটি টাকার আয়, ব্যয়, সঞ্চয় ইত্যাদি নিয়েও কথাবার্তা বলছিলেন। রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলের বিলাসবহুল একটি রেস্তোরাঁর জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেশের রথী-মহারথীবৃন্দের একাংশ বড়সড় একটি গোলাকার টেবিলকে ঘিরে চক্রাকারে আরাম কেদারায় বসে ওসব আলোচনা করছিলেন এবং ফাঁকে ফাঁকে উপাদেয় খাবার মুখে দিয়ে রসনাতৃপ্ত করছিলেন। আলোচনার টেবিলে আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ এবং সার্বিক বিচারে সর্বদিক থেকে অনভিজ্ঞ। কাজেই কথা না বলে নীরবে মহাজনদের কথাবার্তা শুনে জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে চেষ্টা করছিলাম। উপস্থিত সুধীবৃন্দের মধ্যে ছিলেন দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, আমলা, কূটনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ দেশের মিডিয়া ও ফ্যাশন হাউসগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। আমি যে টেবিলে ছিলাম সেটির জৌলুস অন্য টেবিলগুলোকে আকর্ষণ করছিল এ কারণে যে, দেশের শীর্ষ এবং তারকা রাজনীতিবিদগণ সেখানে দেশ-জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি কৌতূহল উদ্দীপক নানা কথাবার্তায় পুরো পরিবেশকে মুখরিত করে রেখেছিলেন। সবাই হাসিমুখে গরিবের দুঃখ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি রসনাযুক্ত খাবার গলাধঃকরণ করতে করতে দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্য সংকট নিয়ে নিজেদের গভীর শঙ্কা ও উদ্বেগের কথা বলছিলেন।

একজন আলোচক বললেন, দেশের দুর্নীতির বাজার এখন রীতিমতো দুধ সাগরে পরিণত হয়েছে। পূর্বে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করার জন্য কালো রং ব্যবহূত হতো। সমাজ দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করত এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বয়কট করত। দুর্নীতিবাজরা ইতিপূর্বে অভিজাত সমাজে মিশতে পারত না এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সঙ্গে শত চেষ্টা-তদবির করেও আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারত না। ফলে তারা তাদের দুর্বৃত্তায়নের ধন-সম্পত্তি এবং অর্থবিত্ত নিয়ে অন্য জেলায় গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হতো। অন্যদিকে বর্তমানের দুর্নীতিবাজরা সাদা বাড়ি, সাদা গাড়ি এবং সাদা পোশাকে এমন গর্বভরে চলাফেরা করে যা দেখে সাধু-সজ্জনেরা অন্ধকারে মুখ লুকাতে বাধ্য হয়। দেশের অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ বিধি ব্যবস্থার মতো দুর্নীতিও রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। এই সেক্টরেও ভিভিআইপি, ভিআইপি অথবা সিআইপি মর্যাদা প্রদানের বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রথম আলোচকের কথা শেষ হতেই দ্বিতীয় আলোচক বলে উঠলেন যে, দুর্নীতির সাগরে যদি কেউ একবার ডুব দিতে পারে তবে তার ধবল রং প্রাপ্তি একেবারে নিশ্চিত। ছিটেফোঁটা দুর্নীতি করে বর্তমান সমাজে কেউ টিকতে পারবে না। এ সমাজ ছিঁচকে চোর, টাউট-বাটপার, পকেটমার, ছিনতাইকারী, সিঁধেল চোর প্রভৃতির ব্যাপারে মারাত্মক কঠোর। কিন্তু সাগর চুরির নায়কদের ব্যাপারে অতিমাত্রায় উদার। আর সেসব চোর-ডাকাত যদি একবার দুর্নীতির দুধ সাগরে ডুব দিয়ে একটু সাদা রং ধারণ করতে পারে তবে তো কথাই নেই— তাদের টিকিটি স্পর্শ করার ক্ষমতা তখন আর কারও থাকে না। উল্টো তারা হয়ে যায় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, অসহায় ও দুর্বলদের ভাগ্যবিধাতা এবং সৎ ও চরিত্রবান মানুষজনের স্বীকৃতি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ। সাহিত্য রসবোধসম্পন্ন জনৈক আলোচক আদিকালের দেবতার যুগে সাগর মন্থন করে অমৃত উদ্ধারের কাহিনী নিয়ে কবি নজরুল রচিত সিন্ধু কবিতার কয়েকটি লাইনের সাম্প্রতিক ভাব-সম্প্রসারণ করতে গিয়ে বললেন, দুর্নীতিবাজরা কেবল দুর্নীতির দুধ সাগর সৃষ্টি এবং সেই সাগরে ডুব দিয়ে শ্বেত শুভ্র রূপে জাতে ওঠার মধ্যেই নিজেদের মাত্রা সীমিত রাখবে না। তারা দুর্নীতির দুধ সাগরে দুধকেলি করতে করতে সেই সাগরের বুকে দুর্নীতির মস্ত বড় এক ননীর পাহাড় সৃষ্টি করে ফেলবে। তারপর দুধ সাগরের ক্রীড়াবিদরা নিজেদের মধ্য থেকে সবচেয়ে সফল দুর্নীতিবাজটিকে নিজেদের স্বপ্নের রাজকুমার বানিয়ে ননীর পর্বতের চূড়ায় স্থাপন করে এমনভাবে তপস্যার উল্লাসনৃত্য শুরু করে দেবে, যা দেখে আমজনতা দুর্নীতির ননীর পর্বতের বাসিন্দা সেই কথিত রাজকুমারের ভাবশিষ্য হওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করে দেবে। ফলে মহাকালের সেই ক্রান্তিকালে তা-ই ঘটতে থাকবে যার কথা বহু পূর্বে বলে গিয়েছিলেন মহামতি সক্রেটিস।

সর্বশেষ খবর