বুধবার, ৭ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভ্যাটে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা

বাজেটে ব্যবসায়ীদের কোনো প্রস্তাব আমলে নেয়নি এনবিআর, সংকট মোকাবিলায় কমিটি

রুহুল আমিন রাসেল

সরকারের ভিতর ভ্যাট ষড়যন্ত্রে চরম ক্ষুব্ধ সারা দেশের ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, দুই শতাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে দফায় দফায় লোক দেখানো বৈঠক করে এনবিআর। এতে ভালো ভালো কথা বলা হলেও কোনো প্রস্তাবই আমলে নেয়নি সংস্থাটি। বরং সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। উসকে দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষকে। সরকারপন্থি ব্যবসায়ীরাও বলতে বাধ্য হচ্ছেন, এই বাজেট গণমুখী নয়। তবে নির্বাচনী এই বাজেটে ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় একটি কমিটি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

প্রস্তাবিত বাজেটের কঠোর সমালোচনা করে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই বাজেট প্রণয়নে এনবিআরের কাঠামোগত দুর্বলতা আছে। কারণ এনবিআর বলছে, ভ্যাটের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। কিন্তু কীভাবে বাড়বে না তা আমাদের বোঝানো হচ্ছে না। আমরা এটা বুঝতে চাই।’ তার মতে, ১৫ শতাংশ ভ্যাটে ফ্ল্যাট, কাগজের দাম বাড়বে। বিদেশে ভ্রমণ খরচ বাড়ানো ঠিক হয়নি। এ পদক্ষেপগুলো বিনিয়োগবিরোধী বলেও মনে করেন এই শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ীরা অভিযোগে বলছেন, বাজেটে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট নির্ধারণ করায় দেশের শিল্প খাত চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করের বোঝা বেড়ে যাবে, যার প্রভাব ভোক্তার ওপর পড়বে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দাম। এসব সংকট উত্তরণে বাজেট প্রস্তাবের আগে দীর্ঘদিন দুই শতাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে প্রাক-বাজেট নামের দফায় দফায় লোক দেখানো বৈঠক করে এনবিআর। সংস্থাটির চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ওই সব বৈঠকে ব্যবসায়ীদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বললেও ব্যবসায়ীদের কোনো প্রস্তাবই আমলে নেওয়া হয়নি। ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছেন, যদি তাদের দাবির কোনো প্রতিফলনই না হবে, তাহলে তথাকথিত এই প্রাক-বাজেট বৈঠকের প্রয়োজন কী? লোক দেখানো প্রাক-বাজেটের নামে এনবিআর সরকারের সঙ্গে দুই নম্বরি করেছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর চাওয়া-পাওয়াকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি এনবিআর। প্রস্তাবিত বাজেটে বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া হয়নি। বরং রপ্তানির নামে আসা বন্ডেড পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করতে চোরাকারবারিদের সহায়তা করা হয়েছে। দেশে এখন রাত হলেই চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য দেখা যায় রাজধানীর ইসলামপুর ও বাবুবাজারে। সেখানে গেলেই দেখা মেলে ট্রাকে ট্রাকে বন্ড সুবিধায় আনা কাপড় বিক্রি হচ্ছে কালোবাজারে। এই অনিয়মের সঙ্গে এনবিআরের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তাও জড়িত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল বলেন, এই বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে কিছু লোক সরকারকে আগামী নির্বাচনে বিব্রত করতে ষড়যন্ত্র করেছে। ষড়যন্ত্র থাকলে এমন বাজেটই হবে। তাই কোনোভাবেই এই বাজেটকে গণমুখী বলা যাবে না। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, নতুন ভ্যাট আইন উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর। এনবিআর বলেছে, ২ লাখ লোককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ২০০ লোককেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। শতাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা করা হলেও প্রস্তাবিত বাজেট দেখে মনে হয়েছে, ভ্যাট-সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো পুরোপুরি কাটপেস্ট করা হয়েছে। এমন বাস্তবতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভ্যাট আইন কার্যকর না করে ২০১৯ সালে বাস্তবায়ন শুরু করা উচিত। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে আগামী জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনের আগে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে যখন সামাজিক গণমাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে সোচ্চার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা, তখন সংকট মোকাবিলায় একটি ‘বাজেট পর্যালোচনা কমিটি’ গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে আহ্বায়ক করে সদস্যসচিব করা হয়েছে আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি টিপু মুন্সী এমপিকে। এই কমিটিতে আরও আছেন আওয়ামী লীগ ঘারানার বেশ কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা। জানা গেছে, গতকাল ড. মসিউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল মতিঝিলের ফেডারেশন ভবনে দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠকের শুরুতেই আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এ বৈঠক সরকারের পক্ষ থেকে নয়। দলীয়ভাবে আপনাদের সমস্যার কথা শুনতেই আমরা এসেছি।’ ওই বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে মুখ খোলেননি এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তবে বৈঠকে অংশ নেওয়া কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, বৈঠকে এফবিসিসিআই সভাপতি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির প্রথম সহসভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ, বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান এমপি, এফবিসিসিআইর পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তপন চৌধুরী, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাশেম খান, বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, পরিচালক আবু নাসের, শমী কায়সার প্রমুখ। বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেছেন, বাজেটে যেসব পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তা অপ্রচলিত। এটা এনবিআরের প্রবঞ্চনা। সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের ফলে ১৮টি সেবা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব খাতে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপ করা উচিত। প্রয়োজনে ভ্যাট আইন সংশোধন করার দাবি জানিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি। বৈঠকে কী বলেছেন, এমন প্রশ্নে এফবিসিসিআইর পরিচালক আবু নাসের বলেন, ‘আমি শুধু এফবিসিসিআইর পরিচালকই নই, আমি আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীও। এ বাস্তবতায় প্রস্তাবিত বাজেটে এমন কোনো উপাদান আমি পাইনি, যেখানে বাজেটের পক্ষে একটু কথা বলতে পারি। আমি মনে করি, এনবিআরের কতিপয় কর্মকর্তা জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের অর্থায়নে প্ররোচিত হয়ে এই বিতর্কিত বাজেট তৈরি করেছে।’

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করে এফবিসিসিআই বলেছে, আমরা হ্রাসকৃত হারে বিভিন্ন স্তরে মূসক হার নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু বাজেটে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাটের পরিবর্তে সিঙ্গেল রেট ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে দেশের শিল্প খাত, বিশেষ করে এসএমই ও প্রান্তিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ী হিসাবপত্র সঠিকভাবে না রাখতে পারায় কর রেয়াত নিতে সক্ষম নন, তাদের ওপর করের বোঝা বেড়ে যাবে। এর প্রভাব ভোক্তার ওপর পড়বে। এতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। তাই হ্রাসকৃত হারে বিভিন্ন স্তরে মূসক হার পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব করেছে এফবিসিসিআই।

সর্বশেষ খবর