শনিবার, ১০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

আত্মহত্যা না হত্যা

তিন সন্তানসহ মায়ের রহস্যজনক মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

আত্মহত্যা না হত্যা

স্বজনের আহাজারি, নিহত দুই শিশু সাদ (উপরে) ও শান্তা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর তুরাগের কামারপাড়ার কালিয়ারটেকের একটি টিনশেডের বাসা থেকে তিন সন্তানসহ মায়ের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে তুরাগ থানা পুলিশ গতকাল ভোর রাতে ওই বাসা থেকে লাশ চারটি উদ্ধার করে। চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এ ঘটনাটি নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, চারটি লাশ তারা ওই বাসা থেকে উদ্ধার করেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, একটি ঘরের খাটে ছিল তিন সন্তানের লাশ। আরেক ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে  গলায় ফাঁস নেওয়া অবস্থায় ঝুলে ছিল তাদের মায়ের দেহ। তিন সন্তানসহ মায়ের লাশ উদ্ধারের পর পুরো এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। শত শত মানুষ ওই বাসার সামনে ভিড় করতে থাকেন। গোটা এলাকায় ছিল শোকের ছায়া। নিহতরা হলেন রেহেনা পারভীন (৪০), তার তিন সন্তান শান্তা (১৩), শেফা (৮) ও সাদ (৮ মাস)। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। রেহেনা পারভীনের স্বামীর নাম মোস্তফা কামাল। শান্তা কামারপাড়ায় পরশমণি ল্যাবরেটরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত, শেফা পড়ত প্রথম শ্রেণিতে। চার লাশের ময়নাতদন্ত গতকালই সম্পন্ন হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। সরেজমিনে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, তিন সন্তানের গলায় ওড়না পেঁচানো রয়েছে। যার মধ্যে বড় মেয়ে শান্তার গলায় হলুদ রঙের ওড়না দিয়ে পেঁচানো এবং দুই পা গোলাপি রঙের জর্জেট ওড়না দিয়ে বাঁধা রয়েছে। তার পরনে ছিল গোলাপি রঙের সালোয়ার-কামিজ। ছোট মেয়ে শেফার গলায় ওড়না পেঁচানো ছিল। গায়ে ছিল লাল কালো রঙের সালোয়ার-কামিজ। অন্যদিকে আট মাসের শিশু সাদের গলায় নীল ও সাদা রঙের গ্রামীণ ওড়না পেঁচানো রয়েছে। সাদা রঙের প্যান্ট ও জামা পরা। ছোট মেয়ের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। পুলিশ ধারণা করছে, তিন সন্তানকে গলায় ওড়না বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মা সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, তিন শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তবে মায়ের মৃত্যু রহস্যজনক। কারণ তার ঘাড়ে একটু জখমের চিহ্ন রয়েছে।

এদিকে স্থানীয়রা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না মা তার তিন সন্তানকে একই কায়দায় একে একে নিজ হাতে খুন করতে পারেন। শান্তা আর শেফাকে স্থানীয়রা খুব আদর করত। যে কারণে গোটা এলাকায় ছিল শোকের আবহ। ঘটনার সময় রেহেনার স্বামী মোস্তফা কামাল বাসায় ছিলেন না। তিনি রাতে এসে তার স্ত্রীকে ঝুলন্ত অবস্থায় পান। তিন শিশু সন্তানকে পান খাটের ওপর। তিনি বলেন, কিছু দিন ধরে তাদের সংসারে অর্থ সংকট চলছিল, তা থেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে তার স্ত্রী এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারেন। তবে রেহেনার আত্মীয়স্বজনরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অভিযোগ, রেহেনার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের খুন করেছেন।

তুরাগ থানার ওসি মাহবুবে খোদা বলেছেন, ‘ধারণা করছি, তিন সন্তানকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছেন। তবে এর পেছনে অন্য কিছু রয়েছে কিনা, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ কী কারণে এ ঘটনা ঘটল, পারিবারিক কোনো অশান্তির খবর পেয়েছেন কিনা— জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এসব বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’

রেহেনার স্বামী মোস্তফা কামাল জানান, তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একসঙ্গে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ইফতার করেন। তারপর এলাকায় ‘যুব কল্যাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কো-অপারেটিভ লিমিটেড’-এর অফিসে যান। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়ে কামাল এই সমিতি গড়ে তুলেছেন এবং নিয়মিত ওই অফিসে বসতেন। কামাল বলেন, ‘রাতে বাসায় ফিরে দেখি সামনের ঘরে আলো, কেউ নেই। মাঝের ঘরে বিছানায় তিন সন্তান এবং ভিতরের ঘরে ফ্যানের সঙ্গে রেহেনা ঝুলছে। আমি চিৎকার দিই। আশপাশের মানুষও ছুটে আসে। রেহেনাকে নামিয়ে মুখে বাতাস দিয়ে অনেকবার চেষ্টা করেছি বাঁচাতে, কিন্তু পারিনি।’ দ্বিতীয় কক্ষে যে তিন সন্তান মৃত, তা প্রথমে বুঝতে পারেননি বলে জানান কামাল।

আত্মহত্যা, না হত্যা? : রেহেনার স্বামী কামাল বলছেন, কিছু দিন ধরে তার সংসারে অর্থ সংকট চলছিল, তা থেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে তার স্ত্রী এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারেন। কামাল বলেন, তার সংসারে আগে সচ্ছলতা থাকলেও সম্প্রতি দুরবস্থা নেমে আসে। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানায় বড় পদে অনেক বেতনে চাকরি করতাম। পরে ফ্ল্যাটের ব্যবসা থেকে শুরু করে অনেক কিছু করেছি। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান দিয়ে কিছু দিন ধরে অনেক কষ্টে চলতে হচ্ছিল। ওদের স্কুলের বেতনও ঠিকমতো দিতে পারতাম না।’ এসব নিয়ে রেহেনা দুর্ভাবনায় ছিলেন জানিয়ে কামাল বলেন, ‘হয়তো টেনশন থেকে সে এই কাজ করেছে।’ জরুরি বিভাগের যেখানে কামাল ছিলেন, তার অদূরেই থাকা রেহেনার স্বজনরা বলেন ভিন্ন কথা। রেহেনার বোন রোজিনা সুলতানা বলেন, ‘শাশুড়ি, ননদসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন তদের হত্যা করেছেন। ১৭ বছর তাদের বিবাহিত জীবন। কোনো দিন আমার বোনকে শান্তি দেননি তারা।’ হত্যা কেন করবে— প্রশ্ন করা হলে পাশে থাকা আরেক বোনের মেয়ে আসমা আক্তার বলেন, ‘কামারপাড়ার ওই বাসার জমিটি রেহেনার শ্বশুরের। ২০টি টিনশেড ঘর রয়েছে এবং তার ভাড়া তুলতেন রেহেনার শাশুড়ি মাফিয়া বেগম ও ননদ কোহিনুর। ভাড়া তোলা নিয়ে খালার (রেহেনা) সঙ্গে তারা (শাশুড়ি ও ননদ) অনেক ঝগড়া করতেন।’ রেহেনার বড় ভাই মাহবুব আলম সাগর জানান, ‘কামালের মা, ভাই-বোন তার সম্পত্তি দখলের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ অত্যাচার করে আসছিলেন রেহেনাকে। অবশেষে আমার বোন তা সইতে না পেরে তার সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে। ঘটনার তিন দিন আগে আমি আমার বোন এবং ভাগনি ও ভাগনেদের দেখতে আসি তখন দেখি আমার বোন শুধু লাউ পাতা রান্না করেছিল। তখন আমি বাজার সদাই করে দিয়েছি। দশটা মুরগিও দিয়েছিলাম। পরে আমার বোন বলল, “ভাই! তুই আর এখানে আসিস না, তোকে মেরে ফেলবে”।’ মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় বসবাসকারী রোজিনা বলেন, ‘রাতে রেহেনার মৃত্যুর খবর আমাদের অন্য ভাড়াটিয়ারা দিয়েছেন, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির কেউ দেননি। এটা থেকে আপনারা (সাংবাদিক) বুঝে নিন।’ ‘এত সুন্দর সন্তানকে কোনো মা এভাবে হত্যা করতে পারেন না,’ বলেন তিনি। রোজিনা জানান, তারা ছয় বোন, চার ভাইয়ের মধ্যে রেহেনা ছিলেন পঞ্চম। ২০০০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন তিনি, পরে সমাজকল্যাণে এমএ ডিগ্রি নেন। ‘শাশুড়ি ও ননদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য অনেক চাকরি খুঁজেছেন, কিন্তু ভালো কোনো চাকরি পাননি।’

হত্যার অভিযোগের বিষয়ে রেহেনার স্বামী কামাল বলেন, ‘দেখুন, আমার মরেছে তিন সন্তান আর তাদের মরেছে একজন। কষ্ট তো আমারই বেশি হচ্ছে, তাই না।’ তার দাবি, তার মা (রেহেনার শাশুড়ি) তিন মাস ধরে তাদের বাসায়ই আসেন না।

কামাল জানান, ২০টি ঘরের মধ্যে তিনি তিনটি ঘর নিয়ে থাকেন এবং তার বোন কোহিনুর তিনটি ঘর নিয়ে থাকেন। বাকি ১৪টি ঘর ভাড়া দেওয়া, যার টাকা তার মা নেন। অন্য কেউ হত্যা করতে পারে কিনা— জানতে চাইলে কামাল বলেন, ‘স্থানীয় দুই প্রভাবশালীকে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম ডেসটিনির ব্যবসার জন্য। সেই টাকা তো আর পাইনি, তাদেরও হাত থাকতে পারে।’ তবে দুই ‘প্রভাবশালী ব্যক্তির’ নাম বলেননি কামাল। তুরাগ থানার ওসি মাহবুব বলেন, ‘পুলিশ সবকিছু নিয়েই তদন্ত করছে। এর পেছনে কী রয়েছে, তা বের করা হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর