শনিবার, ১০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্ম চিন্তা

তোমার পদস্পর্শ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

তোমার পদস্পর্শ

এক ভদ্রলোক এসএমএস করলেন। জানালেন, তার বাবার নাম মুস্তাফা জামান আব্বাসী। ভাবলাম এটা কীভাবে সম্ভব? আমার নেই কোনো পুত্রসন্তান। সামান্য সম্পত্তির লোভে হয়তো তিনি আমার পুত্র হতে চাচ্ছেন। আমার বড় ভাইয়ের তিন মেয়ে। তারা প্রতিষ্ঠিত। আমার বোনের দুই ছেলে। তারাও প্রতিষ্ঠিত। আমার দুই মেয়ে হওয়ার পর সুরেশ্বর দরবারে বেড়াতে যাই। সে অনেক দিন আগের কথা। আমার গানের ভক্ত নূরে বেলালের বাবা হলেন পীর সাহেব। পীর সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলে নেই? বললাম না। ভাইয়েরও ছেলে নেই। যদি আমার ছেলে হতো সব গান তাকে শিখিয়ে যেতে পারতাম। ছেলেটির নাম হবে মুস্তাফা জামান আব্বাসী। ইউরোপে চল আছে এবং চৌদ্দ-পনের পুরুষ পর্যন্ত একই নাম বয়ে চলেছে যেন নদীর মতো। পীর সাহেবের মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু কিছুই বললাম না। আমার স্ত্রী অরাজি। আবার নামে চলে আসি। করাচিতে গেলাম রেকর্ড করতে। সঙ্গে কানাইলাল শীল আমাকে গান তুলে দিলেন, আর আমি রেকর্ড করলাম। গান চারটি : ‘আমায় ভালবেসে দিলি এত জ্বালা নিঠুর কালা রে’, ‘ও মন মাঝিরে কোন ঘাটে তুই ভিড়াবি তোর নাও’, ভাওয়াইয়া : ‘ও ধন মোর কানাইয়া রে’। অন্য পিঠে : ‘ওরে কাটোল খুটার ওরে দোতরা’। চার গানেই মাত। কে এই নতুন শিল্পী? কেন আব্বাসউদ্দীনের ছেলে? নাম : মুস্তাফা জামান আব্বাসী। আব্বাকে রেকর্ডটি বাজিয়ে শোনালাম। চোখেমুখে তার নতুন দ্যুতি। এ যে নতুন আব্বাসউদ্দীন। বেদারউদ্দিন থেকে আলাদা, সোহরাব হোসেন থেকে আলাদা। সবচেয়ে খুশি হলেন ‘আব্বাসী’ নামটি দেখে। কোন পিতা এটি দেখে খুশি না হবে? ফেসবুকে আমার সহস্র বন্ধু। কোথাও এ নামটি নেই। অর্থাৎ নামটি আমার একক। তাই আমার বন্ধুরা আমাকে আব্বাসী বলেই চেনে, অর্থাৎ আব্বাসউদ্দীনের পুত্র। আবার অনেকের ধারণা, আমার কোনো গুণ নেই, ওই নামটি ভাঙিয়েই বেঁচে আছি। কথাটি সত্যি হতেও পারে। আবার হতে পারে সর্বৈব মিথ্যা। তাকে নিয়ে বই লিখেছি। সারা জীবন তার গান গেয়েছি, রেকর্ডে, ক্যাসেটে ও সিডিতে। কয়েকবার দুনিয়া ঘুরে এসেছি। সবখান থেকে পেয়েছি ফুলের মালা। দেশের মালার প্রয়োজন অনুভব করিনি। আজও নয়। এগুলো আসলে দলের মালা। আমার পিতা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি বেঁচে থাকতে একটি ফুলের মালাও পাননি। তাহলে আমি কেন আফসোস করব যেগুলো দলীয় মালা সেগুলোর জন্য? আমি কোনো দলে যোগদান করতে চাইলে সর্বশ্রেষ্ঠ মালাটি আমার গলাতেই ঝুলত। তার প্রার্থী নই। গ্রামেগঞ্জে যেখানেই যাই অভূতপূর্ব সংবর্ধনায় আপ্লুত। দেশের লোক আমাকে ভালোবাসে। তার একটিই কারণ, তা হলো : আব্বাসউদ্দীনের একমাত্র জীবিত পুত্র আমি। আমাকে যারা হিংসা করে তাদের জন্য করুণা হয়। আমি আব্বাসউদ্দীনের ছেলে এটা তো আমার অপরাধ নয়। আমি কোথাও গিয়ে বসতে চাইনি। আমাকে কোনোখানে কেউ ডাকে না। প্রতি চাকরি অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি এবং হারিয়েছি। কাদের কাছ থেকে, জেনে নেবেন। এবার আসি ফেসবুকে। এক ভদ্রলোক আমার নামটি গ্রহণ করেছেন। পৃথিবীতে দ্বিতীয় মুস্তাফা জামান আব্বাসী আবিষ্কার করলাম। তিনি বন্ধু হতে চাইলেন, রাজি হলাম। পৃথিবীতে আমার একমাত্র মিতা। তার সঙ্গে দেখা হয়নি। ব্যস্ত বিধায় আর যোগাযোগ হয়নি। এর আগে বন্ধু মুস্তাফা জামাল [ফরেন সার্ভিস] ছিল আমার মিতা। আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। সে ছিল রাজপুত্রের মতো দেখতে। একবার কলকাতায় তার বাসায় বিরাট পার্টি। সবাই পানে মত্ত। আমি গিয়েছিলাম ভূপেন হাজারিকার গান শুনব বলে। কিন্তু বিনি পয়সার ভোজে ও পানীয়তে তার কণ্ঠ বিপর্যয় ঘটেছে। আর আমার কণ্ঠ তুঙ্গে। দুই ঘণ্টা গান গাইলাম। ভূপেন আমাকে গলায় জড়িয়ে ধরলেন। ভাঙা গলায় বললেন, ‘আব্বাস ভাইকে পাইনি। তিনি ছিলেন আমার গুরু। আর তুমি হলে আমার প্রাণের বন্ধু।’ সেই দিন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভূপেন ছিলেন আমার প্রাণের বন্ধু। তিনি গাইতেন হাতির পিঠে মাহুতের গান, আর আমি গাইতাম মৈশালের পিঠে ভাওয়াইয়া গান। সারা জীবন তিনি আমাকে ভালোবাসা দিয়েছেন। কোনো দিন ভুলব না। মুস্তাফা জামাল, আমার মিতা কিছু দিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঢাকা ক্লাবে কয়েক দিন দেখা। তাকে উপদেশ দিলাম ওই ঘরে আর ঢুকিস না। আমাকে ফলো কর। সে আমার কথা শোনেনি। কিডনি ফেইলিউর হয়ে সে মারা যায়। আমার একমাত্র মিতাকে আমি হারাই। তাকে আমি কোনো দিনও ভুলতে পারব না। মোবাইলে যিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে অনেক পৃষ্ঠার প্রয়োজন হবে। তিনি এসেছেন সেই বহু যুগের ওপার থেকে মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ থেকে। তার পিতার নাম মুস্তাফা জামান আব্বাসী। আমি তাকে দেখতে যেতে চাই। কিন্তু তা আমি পারব না। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট সুফি, লোকালয়ে আসতেন না। প্রায় কিছুই খেতেন না। আল্লাহ তার খাবার জোগাতেন। সব সময় জিকিরে থাকতেন। আমার শখ হয় যদি তাকে একটিবার কদমবুসি করতে পারতাম, তাহলে আমার জীবন সার্থক হতো। এই নামটি আমার জন্য মূল্যবান। তুমি আমাকে দেখা না দিয়ে কেন চলে গেলে? কী হতো যদি তোমার পদস্পর্শ করতে দিতে। আমার চোখে পানি। মুস্তাফা জামান আব্বাসী, সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব, [email protected]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর