বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

মৃত্যু যেখানে হানা দেয় বার বার

সাঈদুর রহমান রিমন

সেখানে মৃত্যু হানা দেয় বার বার। বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড় ধসে। মাটি চাপায় শুরু হয় মৃত্যুর মিছিল। ঘটনা ঘটলেই উদ্ধার তত্পরতা আর ছোটাছুটি চলে। শুরু হয় তোড়জোড়। কদিন পেরোলেই সবকিছু চাপা পড়ে। ক্রমেই বাড়তে থাকে পাহাড় চূড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। সেখানে টানা বৃষ্টিপাত দেখলেই প্রমাদ গোনে মানুষজন। আঁতকে ওঠেন—কখন বুঝি পাহাড় ধসে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। গত রবিবার চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানে পাহাড় ধসে ১৩৫ জনেরও বেশি লোকের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে পাঁচ শতাধিক পাহাড় টিলায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। চট্টগ্রাম শহরেই ছোট-বড় শতাধিক পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস রয়েছে এক লাখের বেশি মানুষের। আর রাঙামাটি-বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় এ ধরনের বসবাসের হার কয়েকগুণ বেশি। অনেক পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় বাড়িঘর বানিয়ে চরম ঝুঁকিতে বসবাস করছেন তারা। এসব টিলা-পাহাড়ের নিচের অংশেই চলে মাটি বাণিজ্য। একশ্রেণির ঠিকাদার সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সারা বছর পাহাড় কেটে মাটি কেনাবেচার রমরমা বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। বেশুমার কাটাকাটিতেই সবুজ গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। এখন সামান্য বৃষ্টিপাতেই পাহাড়ের মাটি ধসে ভয়াবহ দুর্যোগের সূত্রপাত ঘটে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, এক শ্রেণির লোক নিজেদের বেশুমার ব্যবসায়িক স্বার্থে পাহাড় কাটছে। তাদেরকে ছাড় দেওয়াও হচ্ছে বার বার। এই ছাড় দেওয়ার ফলেই অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অঞ্চলের পাহাড়ের উপরিভাগের মাত্র কয়েক ফুট মাটি শক্ত থাকলেও পুরো পাহাড় গঠনে রয়েছে বালির আধিক্য। ফলে বর্ষা মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতেই পাহাড়গুলোর নিচের দিকের মাটি নরম হয়ে যায়। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ধসে পড়ে মাটি, ভেঙে পড়ে বালির স্তর। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল যেন কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। বরং বছর বছর তা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ গত রবিবার মধ্যরাতে পাহাড় ধসে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় অন্তত ১৩৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি-বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ির অলঙ্কার হিসেবে পরিচিত পাহাড় এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। বিগত ২০০৭ সালের জুন মাসে পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ১২৮ জনের মৃত্যুর পরও থেমে যায়নি মৃত্যুর মিছিল। গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধসে অন্তত সাড়ে চারশ নারী-পুরুষ ও শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে চট্টগ্রাম মহানগরীতেই পাহাড় ধসে মারা গেছেন ১৯৪ জন। ২০১৫ সালে লালখান বাজার ও বায়েজিদ এলাকায় দেয়াল চাপায় এবং পাহাড় ধসে মা-মেয়েসহ ছয়জনের করুণ মৃত্যু ঘটে। ২০১৪ সালের নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে তিনজনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে খুলশী থানাধীন ইস্পাহানি মোড় এলাকায় পাহাড় ধসে এক গৃহবধূ মারা যান। একই বছর ২৯ জুলাই নগরীর লালখান বাজার এলাকার ট্যাংকির পাহাড় এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের করুণ মৃত্যু ঘটে। ২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর চার স্থানে পাহাড় ধসে ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাসের বড় বাটালি হিল এলাকায় পাহাড় ধসে মাটি চাপায় একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১৫ জন মারা যান। এর আগে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকার ট্যাংকির পাহাড় ধসে ১১ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৭ সালের ১১ জুন নগরীর কুসুমবাগ, কাইচ্যাঘোনা, সেনানিবাসের লেডিস ক্লাব সংলগ্ন লেবু বাগান, বায়েজিদ বোস্তামী, মতিঝর্ণা পাড়সহ সাতটি স্থানে পাহাড় ধসে মাটি চাপায় নিহত হন ১২৭ জন। অধিক ঝুঁকিতে লামার মানুষ : চট্টগ্রাম মহানগরীর বাইরে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বান্দরবান এলাকার পাহাড়ের চূড়ায় বসবাসকারী মানুষজন। লামা উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নে প্রায় ২ লক্ষাধিক লোকের বসবাস। এখানকার ছোট বড় পাহাড়ে জনবসতির ইতিহাস প্রায় অর্ধশত বছরের। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ পাহাড় চূড়া, পাদদেশ ও কোল ঘেঁষে বসবাস করে আসছে। গত বছর ২৭ জুন রাতে প্রবল বর্ষণে উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের রইম্যাখোলা, পোঁকখাইয়া ঝিরি, মগনামা পাড়া ও রূপসীপাড়া ইউনিয়নের সামাইছড়িতে পাহাড় ধসের মাটি চাপায় মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে একই পরিবারের ১১ জনসহ ২৭ জন। এর আগে ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট আজিজনগর ও গজালিয়ায় একই পরিবারের ছয়জনসহ মারা গেল ১১ জন। ২০১৫ সালের আগস্টে লামা সদর ইউনিয়নের হাসপাতাল পাড়ায় পাহাড় ধসে ছয়জন মর্মান্তিকভাবে মারা যায় এবং তিনজন গুরুতর আহত হন। পাহাড় ধসের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে—আজিজ নগরের হরিনমারা, চিউরতলী, চিউনি পাড়া ও তেলুনিয়া, ফাইতং ইউনিয়নের রইম্যাখোলা, পোঁকখাইয়া ঝিরি, মগনামা পাড়া গজালিয়া, সরই, ফাসিয়াখালী এবং রূপসী পাড়ার পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দারা। এ ছাড়া লামা পৌর এলাকার হাসপাতাল পাড়া, চেয়ারম্যান পাড়া, নুনারবিল পাড়া, কুড়ালিয়ার টেক, টিএন্ডটি পাড়ায়ও লোকজন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীরা জানান, মাথাগোঁজার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই তারা বসবাস করছেন। ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো আশ্রয় কেন্দ্র নেই।

সিলেটে বৃষ্টি হলেই আঁতকে ওঠে প্রাণ : জানা গেছে, সিলেট মহানগর, নগরীর উপকণ্ঠ ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় টিলা ও পাহাড় কেটে কাঁচা-আধাপাকা বাড়ি নির্মাণ করে দীর্ঘদিন বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবারের প্রায় ১০ হাজার মানুষ। পাহাড় বা টিলার নিচে বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস নিষিদ্ধ হলেও প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে। সিলেট শহর ও শহরতলিতে ২৫০টি পাহাড়-টিলা রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় আরও অর্ধশত পাহাড়-টিলা রয়েছে। এর মধ্যে শহরতলির বালুচর এলাকায় ৫১টি পাহাড়-টিলার অবস্থান। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে খাদিমপাড়া ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ গুচ্ছগ্রামের সরকারি দুটি টিলার ওপর আতঙ্ক মনে নিয়ে ঘুমুতে যায় প্রায় শখানেক পরিবার। শুধু গুচ্ছগ্রামই নয়—এ ছাড়া নগরীর উপকণ্ঠের ব্রাহ্মণশাসন, বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমনগর, মেজরটিলা, মংলিরপাড়, খাদিমপাড়া, পীরের বাজার, বটেশ্বর এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। জৈন্তাপুর উপজেলার নয়াখেল, আঞ্জা গ্রাম ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বিভিন্ন টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে আরও কয়েক সহসধিক লোক।

সর্বশেষ খবর