বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ মত

অনিয়ন্ত্রিত বসতি পাহাড় কাটায় ধস

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

পাহাড়ে অনিয়ন্ত্রিত বসতি গড়ে তোলা, নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের ফলদ এবং বনজ গাছ নিধন এবং অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট তৈরির কারণে বার বার এই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। গত ১৮ বছরে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড় ধসে কমপক্ষে প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে চারশ জন মানুষ। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন এরচেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, এ মুহূর্তে পাহাড়কে পরিকল্পনার মধ্যে না আনলে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। বাংলাদেশের পাহাড়গুলো বালু মাটির। এ ছাড়া এর মধ্যে বিভিন্ন সংযোগ স্থলে রয়েছে বিভিন্ন রকমের ফাটল বা চিড়। তাই যখন গাছ কেটে পাহাড়কে ন্যাড়া করে ফেলা হয় তখন বৃষ্টি সরাসরি পাহাড়ের ওপর পড়ে এবং ভিতরে গিয়ে জমা হয়ে এই চিড়গুলোকে দুর্বল করে দেয়। ৩০ বছর আগে পাহাড় ধসের ঘটনা চোখে পড়ত না। কিন্তু যখন থেকে সমতলের মানুষ গিয়ে পাহাড় কেটে বসতি গড়তে শুরু করল তখন থেকেই বাড়তে থাকে পাহাড় ধসের আশঙ্কা। আগে গাছের ওপর পড়ে পানি ঢালে চলে যেত কিন্তু এখন ভিতরে গিয়ে প্রবল চাপে মাটিকে বাইরে নিয়ে আসে। ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। পাহাড় ধসের সমাধানের বিষয়ে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইন বলেন, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিতে হবে। এটাকে লোকালয় বানাতে গিয়ে গাছ কেটে, পাহাড় কেটে ডেকে আনা হচ্ছে বিপর্যয়। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বানানো হচ্ছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। তাই পাহাড় বাঁচাতে হলে প্রচুর পরিমাণে ফলদ এবং বনজ গাছ লাগাতে হবে। কিছু গুল্ম গাছ আছে যেগুলো মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে। এ ধরনের গাছ লাগালে পাহাড় ধসের আশঙ্কা কমবে। এ ছাড়া বৈজ্ঞানিক উপায়ে রাস্তা এবং পরিকল্পনা করে আবাস বানালে পাহাড় ধসে পড়লেও প্রাণহানির মতো ঘটনাগুলো ঘটবে না। আর বনখেকো এবং দখলকারীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। জানা যায়, গত ১৮ বছরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানে পাহাড় ধসে সাড়ে চারশ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে এ বছর চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার এবং বান্দরবানে নিহত হয়েছেন প্রায় ১৫০ জন। ২০১৫ সালের জুনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড় ধস ও পাহাড়ি ঢলে নিহত হন ১৯ জন। ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে নিহত হয়েছেন একজন। ২০১২ সালের জুনে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে পাহাড় ধসে নিহত হন ৯৪ জন। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম নগরীতে নিহত হন ১৭ জন। ২০১০ সালে চট্টগ্রামে তিনজন। ২০০৯ সালে চট্টগ্রামে ধসে নিহত হন তিনজন। ২০০৮ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম নগরীতে নিহত হন ১৪ জন। ২০০৭ সালের জুনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় নিহত হন ১২৭ জন। ২০০৩ সালে কক্সবাজারে পাহাড় ধসে নিহত হন ছয়জন। ১৯৯৯ সালে আগস্টে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নিহত হয় ১৭ জন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হক বলেন, ‘মূলত মানব আগ্রাসনের কারণে পাহাড় মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। পাহাড় ধসের মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে সরকারকে অচিরেই উদ্যোগ নিতে হবে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতি বর্ষায় চার কারণে মৃত্যুকূপে পরিণত হয় পাহাড়। বর্ষা এলেই ঘটছে পাহাড় ধসের ঘটনা। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন পাহাড় নিয়ে দীর্ঘ সময় গবেষণা করেছেন একাধিক গবেষক দল। তাদের গবেষণায় পাহাড় ধসের কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ের মাটির গঠন। এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো বালি জাতীয় মাটির গঠন এবং কঠিন শিলার অভাব হওয়ায় ভারি বর্ষণ হলেই মাটির সহন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে ভারি বর্ষণ হলেই ধসে পড়ে পাহাড়। প্রাকৃতিক নিয়মে পাহাড়ের আদর্শ ‘কোণ’ ২৬ থেকে ৩০ ডিগ্রি হয়। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়গুলো কাটার ফলে পাহাড়গুলোর ‘কোণ’ ৭০ থেকে ৯০ ডিগ্রিতে পরিণত হয়েছে। ফলে বৃষ্টিতে ধসে পড়ছে পাহাড়। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে তৈরি করা হচ্ছে ঘর-বাড়ি এবং রাস্তা। পাহাড়ের ঢালে করা হচ্ছে জুম চাষ। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে নির্বিচারে কেটে ন্যাড়া করা হচ্ছে পাহাড়। এসব কারণে ভারি বর্ষণে ধসে পড়ছে পাহাড়। এ ছাড়া টানা ভারি বর্ষণও পাহাড় ধসের আরেকটা কারণ। জিও সায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষণায় মানুষ এবং প্রাকৃতিক সৃষ্ট বিভিন্ন কারণকে পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গবেষণায় মানব সৃষ্ট কারণগুলোর অন্যতম হচ্ছে— পাহাড়ের গাছপালা কেটে ফেলা, মাটি কেটে ফেলা, পাহাড়ে প্রাকৃতিক খাল বা ঝর্ণার গতি পরিবর্তন, পাহাড়ের ঢালুতে অতিরিক্ত ভার দেওয়া। চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি দল দীর্ঘ সময় চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর ওপর গবেষণা চালায়। ওই গবেষণায় তারা চট্টগ্রামের পাহাড় ধসের চারটি কারণ চিহ্নিত করেন। গবেষণার পর তারা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদফতর এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সংস্থাকে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা দেন। তিনি বলেন, এই প্রস্তাবনার আলোকে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এগুলো বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি জনসচেতনতাও তৈরি করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর