বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভ্যাটে সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার

বন্ধ হবে অনেক পত্রিকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রস্তাবিত বাজেটে সংবাদপত্র শিল্পে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কারণে এ খাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে করেন গণমাধ্যমের বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, সংবাদপত্রকে অন্য পণ্যের সঙ্গে তুলনা করে ভ্যাট আরোপ করা অনৈতিক। সংবাদপত্রকে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রাখার অর্থই হলো— সমাজ উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করা। ভ্যাটে পত্রিকার দাম বাড়বে। পাঠক পাওয়া যাবে না। অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে। সাংবাদিক, কর্মী ও কর্মচারীরা  চাকরি হারাবেন। কিন্তু সংবাদপত্র যেহেতু সমাজ ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, তাই এ শিল্পকে বিশেষ সুবিধার আওতায় রাখার দাবি করেছেন সাংবাদিক নেতারা। 

জানা গেছে, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের নামে অপকৌশলের সুযোগ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর পত্রিকা ছাপানোর কাগজ আমদানি, ছাপার প্লেট ও কালিসহ অপরিহার্য বিভিন্ন পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে। এতে সংবাদপত্র শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার ওপর চাপ আরও বেশি পড়বে। ভ্যাটের মতো একটা উল্টো জিনিস সংবাদপত্রে চাপানোর ফলে পত্রিকাগুলোর সার্কুলেশন কমে যাবে। সব মিলিয়ে পত্রিকার দামের কারণে পাঠক ও বিজ্ঞাপন দুটোই কমবে। এটা সংবাদপত্র শিল্পের প্রতি মারাত্মক হুমকি বলে মনে করেন গণমাধ্যমের অংশীজনরা। এ প্রসঙ্গে তথ্য কমিশনের প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংবাদপত্রের সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে, এটা বোঝাই যায়। মুদ্রণ মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র আমাদের দেশে খুব সীমিত আকারে চলে। সার্কুলেশন খবুই সীমিত। জনসংখ্যার তুলনায় মাত্র অল্প কিছু সংবাদপত্র চলে। সেখানে ভ্যাটের কারণে সংবাদপত্র শিল্প একটা বড় ধরনের বাধাগ্রস্ত হবে। এ শিল্পের বিকাশ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের দেশ সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশ। তারা সংবাদপত্র পড়ে না কেন? তারা সংবাদপত্র কিনে পড়তে পারে না। এটা একটা মূল কারণ। ভ্যাট ও শুল্ক ইত্যাদির কারণে সংবাদপত্রের দাম আরও বেশি বাড়বে উল্লেখ করে সাংবাদিকতার এই শিক্ষক বলেন, ভ্যাটের কারণে মানুষ আরও কম পত্রিকা কিনবেন। শিল্পের অভ্যন্তরে মালিকপক্ষ মনে করবেন, যেহেতু খরচ বেড়ে যাচ্ছে, তাই লোকজন ছাঁটাই করবেন। সাংবাদিক ছাঁটাই হবে। তাতে সংবাদপত্রের মান ব্যাহত হবে। মান ব্যাহত হওয়ার মানেই হলো— সংবাদপত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। যারা পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, তারা অনেকটা দুরবস্থায় পড়বেন। অনেকে চাকরি হারাবেন। তার মতে, বিজ্ঞাপনের অগ্রিম ভ্যাট প্রদান সংবাদপত্রকে অসুবিধায় পড়তে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবাদপত্র অগ্রাধিকার পায়। সেখানে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ভ্যাট ও শুল্ককর আরোপ করায় এ শিল্প বিকাশে বড় ধরনের বাধাগ্রস্ত হবে। জানা গেছে, সংবাদপত্র শিল্পে ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্ট কাগজ আমদানিতে বর্তমানে ৫ শতাংশ শুল্ককর ও ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর-মূসক বা ভ্যাট দিতে হয়। সব মিলিয়ে ২০ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রকৃত কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র শিল্পে ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্ট, কালি, প্লেট ও প্রিন্টিং ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে শুল্ককর, ভ্যাট এবং বিজ্ঞাপনের অগ্রিম আয়কর (এআইটি) প্রত্যাহারের দাবি করেছেন এ খাতের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-নোয়াব।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও নিউজটুডে’র সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাজেটে ভ্যাট ও করের যে প্রস্তাব, তাতে সংবাদপত্রের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হবে। অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, যদি কিছু পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সাংবাদিক-কর্মচারী বেকার হয়ে যেতে পারেন। সংবাদপত্রকে অন্য পণ্যের সঙ্গে তুলনা করে ভ্যাট আরোপ করা হবে অনৈতিক। সংবাদপত্রকে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রাখার অর্থই হলো— সমাজকে বিকশিত করতে না দেওয়া। গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে না দেওয়া। এ কথাটা সরকারকে বুঝাতে হবে। এটা বিবেচনা করে সরকার করের বোঝা কমিয়ে সংবাদপত্রকে দেশের সেবা করতে সুযোগ দেবে বলে মনে করেন প্রবীণ এই সাংবাদিক। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, সংবাদপত্র শিল্পের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সব কাগজেরই খারাপ। বিজ্ঞাপনের আকার কমে গেছে। বিজ্ঞাপনের মূল্য যা আছে, সে হারে টাকা পাওয়া যায় না। এমনিতেই চাপের মধ্যে কাজ করছে সংবাদপত্র শিল্প। সব কাঁচামালের ওপর করের বোজায় সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। কীভাবে সামাল দেওয়া হবে জানি না। তিনি বলেন, সংবাদপত্র চাল, লবণ, তেল, আদার মতো নয়। এটা ভিন্ন ধরনের শিল্প। এ জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সংবাদপত্রকে নানাভাবে সহায়তা করে। সেখানে বাংলাদেশে চাপে রাখা হয়, যাতে সংবাদপত্র সোজা হয়ে না দাঁড়াতে পারে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র মহাসচিব ওমর ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংবাদপত্র শিল্পে ভ্যাট আরোপ হলো— মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পুরো সংবাদপত্র শিল্পটাই এখন বিপদের মধ্যে আছে। সামনে নবম ওয়েজ বোর্ড। এটা হলে সংবাদপত্র শিল্পে খরচ বাড়বে। সে ক্ষেত্রে আমরা চাই যে— নবম ওয়েজ বোর্ডের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের যে সুবিধা বাড়বে, মালিকদেরও যেন সরকার বিশেষ সুবিধা দেয়।

শুল্ককর ও ভ্যাটে সংবাদপত্র শিল্পে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে এই সাংবাদিক নেতা বলেন, মালিকরা যখনই কর-ভ্যাট দিতে যাবেন, তখন তারা সংবাদপত্রের সাংবাদিক, কর্মী ও কর্মচারী ছাঁটাই করবেন। এতে আমাদের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এমনিতেই সংবাদপত্র একটা চাপের মধ্যে আছে ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার কারণে। পুরো বিশ্ব চলে যাচ্ছে মোবাইলে অনলাইন মিডিয়ার কবলে। এমন পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রকে বরং সহায়তা দেওয়া উচিত ছিল। সেখানে ভ্যাটের মতো একটা উল্টো জিনিস সংবাদপত্রের ওপর চাপানো হচ্ছে। এতে পত্রিকাগুলোর সার্কুলেশন কমে যাবে। পত্রিকার দাম বাড়বে। দাম বাড়লে পাঠক পাওয়া যাবে না। জাতীয় পত্রিকার চেয়ে স্থানীয় পত্রিকার ওপর চাপ আরও বেশি পড়বে।

তিনি আরও বলেন, বিজ্ঞাপনের ওপর অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপের কারণেও ক্ষতি হবে। ফলে পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপনও কম পাবে। এর বাইরে আবার যোগ হয়েছে ই-টেন্ডারিং। এর ফলে অনলাইনের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এতে পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপন হারাচ্ছে। একটা বিজ্ঞাপন এক পৃষ্ঠা হতে পারে, কিন্তু ই-টেন্ডারের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় মাত্র তিন লাইন দিয়ে বলা হতে পারে— বাকি অংশ আপনি অনলাইনে দেখুন। সব মিলিয়ে আমি মনে করি পত্রিকার দামের কারণে পাঠক ও বিজ্ঞাপন দুটোই কমবে। এটা সংবাদপত্র শিল্পের জন্য একটা ভয়ঙ্কর হুমকি। সংবাদপত্র শিল্পের গত কয়েক শত বছরের ঐতিহ্য ও জনমনে যে প্রভাব, তার প্রতি এমন বিরূপ আচরণ কোনোভাবে কাম্য নয়। গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সংসদে আলোচনা করে প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগে সংবাদপত্রে ভ্যাট প্রত্যাহার করা উচিত। তার মতে, বাসাবাড়িতে যেসব গরিব পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করে, তারাও কিন্তু নিউজপ্রিন্ট ব্যবহার করে। ফলে শিক্ষার ওপরও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যারা গরিব ও প্রান্তিক পরিবারের সন্তান তারা কিন্তু নিউজপ্রিন্ট কিনে পড়ালেখা করে।   

সর্বশেষ খবর