শিরোনাম
শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
দিল্লির চিঠি

দলটির বোঝা উচিত জনমনে রাহুলের ঠাঁই মিলছে না

কুলদীপ নায়ার

বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া আর জবাইয়ের জন্য গরু বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা একই মুদ্রার দুই পিঠ। এতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সংকীর্ণতাই ফুটে ওঠে। দুটি ব্যাপারই কলুষিত করছে পরিবেশ। ক্ষমতায় আসার তিন বছর পার হওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার হিন্দুত্ব জাহির করবার বিভিন্ন কাজকে লাই দিয়ে চলেছে। ফলত ধীরে ধীরে অথচ ক্রমান্বয়ে গোটা ভারতকে গ্রাস করছে হিন্দুত্ব।

শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে মনে হয়। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথের শাসনকার্যের ধরন বলছে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ছে। ওই রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে হিন্দুত্ববাদীদের বসানো শুরু হয়েছে। নয়াদিল্লির অবস্থাও তাই। নেহেরু মেমোরিয়াল সেন্টারের পরিচালককে সরিয়ে দিয়ে সেখানে বসানো হয়েছে আরএসএস আদর্শনিষ্ঠ এক ব্যক্তিকে, যিনি নেহেরু সেন্টারের মূল সৌন্দর্য উদারনৈতিক বাতাবরণ বরবাদ করবার জন্য ডানপন্থি শক্তিকে পুষ্ট করতে চাইছেন। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান কলহ-বিবাদের পেছনেও রাজনৈতিক দলগুলো একই মতলবে কাজ করছে। ডানপন্থি শক্তিগুলোকে জড়ো করবার উদ্যোগ যে জোরদার তা বোঝা যায়। তাদের উগ্রতা মূর্ত করে তুলছে তাদের ছাত্র সংগঠন। এরা ভারতজুড়ে শিক্ষাঙ্গনে চোটপাট করছে। এই তো সেদিন চেন্নাইয়ের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে তারা তাণ্ডব চালিয়েছে। এখানে সহিংসতার তীব্রতা আর বারংবার ঘটানোর মাত্রাটা একটু আলাদা। যেসব ছাত্র গো-মাংস খায় ডানেরা তাদের আক্রমণ করতে এসে বাধা পেয়েছে। এই ক্যাম্পাসের উদার পরিবেশ এখন সেই রাজনৈতিক দলটির ওপর নির্ভর করছে তামিলনাড়ুতে যে দলটির রয়েছে আধিপত্য। উত্তরের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোয় বিজেপি প্রভাব খাটাচ্ছে। কংগ্রেস ও অন্য আঞ্চলিক দলগুলো বিপরীত অবস্থানে সক্রিয়। এর ফলে মানসিক ও আদর্শিক ধারায় দেশটা ভাগ হয়ে গেছে। ক্ষমতায় বসে মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন— ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ।’ অর্থাৎ আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাব। কিন্তু দেখা যায়, তিনি এবং তার দল পথ হারিয়ে ফেলেছেন। এখন তো বিজেপি সরকার হিন্দুত্বের জয়গান করছে, প্রতিনিধিত্ব করছে অসহিষ্ণু ভারতের। দলটির কর্ণধারেরা বজরং দল এবং অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (বিভিন্ন শহরে এরা লাঠি আর অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দেয়) জজবায় প্রভাবিত হয়ে— হয়তো মনে করেন সমাজকে বিভক্ত করলে তারা বেশি বেশি ভোট পাবেন। ইসলামী আধিপত্যের ভয় দেখিয়ে পাশ্চাত্যে ডানপন্থি দলগুলো যেভাবে ফায়দা লুটতে চাইছে, এরাও অনেকটা সে রকম করছে। আমরা ভুলে যাই যে, আমাদের ভারতের যে গণতান্ত্রিক কাঠামো আছে, তাতে যার যা মন চায় তাই খাবে। কোনো জোরাজুরি করা চলবে না। ভারত বিশাল একটি দেশ, যার প্রতি ৫০ কিলোমিটার অন্তর এলাকায় পোশাক ও খাদ্য আলাদা। এমন দেশে বৈচিত্র্য তো অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে বৈচিত্র্যই ভারতের শক্তি। বৈচিত্র্য মান্য করার কারণেই এ দেশের বিভিন্ন অংশ ফেডারেল কাঠামোয় সংবদ্ধ আছে। জাতীয় মূল্যবোধের মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে বলেই তারা ক্ষমতায় এসেছে, বিজেপির যেসব কট্টরবাদী এ রকম মনে করেন, তাদের পুনর্বার ভাবতে হবে। কংগ্রেসের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল বলে ভোটাররা বিকল্প খুঁজছিল, সেজন্য বিজেপিকে তারা একটা সুযোগ দিয়েছে— এই যুক্তিটায় সত্যতা আছে। কংগ্রেস যদি বংশীয় রাজনীতির ওপর জোর দিয়েই চলে তাহলে তারা ‘আবারও’ ব্যর্থ হবে। দলটির উপলব্ধি করা চাই যে, জনমনে রাহুল গান্ধীর ঠাঁই মিলছে না। দলের অন্যান্য নেতার চাইতে সোনিয়া গান্ধীর গ্রহণযোগ্যতা ঢের বেশি। ইতালীয় হওয়ায় তার যে অসুবিধা হচ্ছিল কালক্রমে তা উবে গেছে, এখন তাকে জন্মসূত্রে ভারতীয়দের মতোই গণ্য করা হয়। সমস্যা হলো, কংগ্রেস তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলায় সোনিয়ার দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কোনো সন্দেহ নেই যে, বিজেপি রাজনীতিকে হিন্দুয়ায়ন করেছে। কিন্তু বর্তমানে জনভাবনায় তো এটাই সক্রিয়। এজন্য মোদির নেতৃত্ব দায়ী। এই জনভাবনা বেশি স্থায়ী হবে না। কারণ ভারতীয়রা মূলত বহুত্ববাদী। মনে হয়, বিজেপি এ বিষয়ে সচেতন। দেখা যায়, দলটি মধ্য-ডানপন্থি থেকে মধ্যপন্থি হয়ে উঠতে চাইছে। যে বাধা দলটিকে ব্যাধিগ্রস্ত করেছে তা হলো, এর ক্যাডাররা এসেছে আরএসএস থেকে। হতে পারে, এজন্যই সরকারে কোনো কেলেঙ্কারি ঘটছে না। আরএসএসের আদর্শ পছন্দ না করতে পারি কিন্তু তারা যে সততা বজায় রাখবার ওপর গুরুত্ব দেয় তাতে সন্দেহ নেই। তবু শাসনকার্যে তারা যে হস্তক্ষেপ করছে সেটা ভোলা উচিত নয়। হিন্দুত্ব দর্শনের কতটা কাছাকাছি সেই বিবেচনায় সরকারি কর্তাদের এমনকি শীর্ষস্থানীয় আমলাদের যোগ্যতা নির্ণয় করা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও উচ্চপদে বেশকিছু ধর্মনিরপেক্ষ অফিসারকে নিয়োগ করেছিলেন। সরকারের বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির জানান দেওয়ার জন্যই অমন করেছিলেন। বাবরি মসজিদ বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে নরসিমার গোপন যোগাযোগ ছিল। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে, ওরা বেইমানি করবে আর মসজিদটা ধূলিসাৎ করে দেবে। ব্যাপারগুলো এখন সিবিআইর একটি কোর্ট যাচাই করছে। এই কোর্ট লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলিমনোহর যোশী ও উমা ভারতীর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছে। বিচার বিভাগ যা করছে তা যদি রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ করে দেয় সেটা হবে বিরাট শোচনীয় ব্যাপার। আদভানি ও তার সহযোগীরা উচ্চতর আদালতে আপিল করতে পারেন বটে। কিন্তু শাসক দল যদি অভিযুক্তদের ফায়দার জন্য কোনো কিছু করে বসে তা হবে আইনের সঙ্গে মশকারা। কংগ্রেস দাবি তুলেছে— ‘মোদি মন্ত্রিসভার সদস্য উমা ভারতীর পদত্যাগ চাই।’ উমাকে বাদ দিয়ে দিলে মোদি যথার্থ একটা বার্তা দিতে পারেন দেশকে। সেটা হচ্ছে : আদালতকে সমর্থন করা ছাড়া কারও পক্ষ নেওয়ার মতো করণীয় কিছু সরকারের নেই।

সর্বশেষ খবর