মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রধানমন্ত্রীর অসন্তোষ, ভ্যাট আইন স্থগিতের নির্দেশ

১৫ শতাংশের জটিলতা

মানিক মুনতাসির

আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরের অপেক্ষায় থাকা নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এর বাস্তবায়ন স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গতকাল মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এবং এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের সঙ্গে ভ্যাট আইন-২০১২ নিয়ে পৃথক বৈঠক করেন। জাতীয় সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে এ বৈঠক হয়। অর্থ বিভাগের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, প্রধানমন্ত্রী আইনটি আরও পর্যালোচনার নির্দেশনা দিয়েছেন।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, বাজেট পেশের আগে বার বার নির্দেশনা দেওয়া সত্ত্বেও এমন একটি বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত কীভাবে এলো? কেন আগে যাচাই-বাছাই করা হয়নি? আইনটি ২০১২ সালে তৈরি। চার বছর সময় পেয়েও কেন এর সমাধান হয়নি? ব্যবসায়ীরা ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করা সত্ত্বেও তাদের দাবি আদৌ আমলে নেওয়া হয়নি কেন—এমন প্রশ্নও রাখেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এ আইনের বাস্তবায়ন আপাতত স্থগিত রেখে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জন করা যায়, সেই পথ খুঁজে বের করুন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইন হবে জনগণের সুবিধার্থে। জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলে এমন কোনো আইন আওয়ামী লীগ সরকার চায় না। সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সাধারণ মানুষকে কোনোভাবেই ভোগান্তিতে ফেলতে চায় না সরকার। সংসদে উত্থাপনের আগে গণভবনে অনুষ্ঠিত বাজেট প্রস্তুতির একাধিক সভায়ও অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, পুরো বাজেট হতে হবে কল্যাণকর। নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের বিরোধিতার কারণও সে সময় জানতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু অর্থ বিভাগ এবং এনবিআরের কিছু কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অর্থমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছিলেন কিনা, গতকাল প্রধানমন্ত্রী এমন প্রশ্নও রাখেন। চার বছর ধরে যেসব কর্মকর্তা এ আইন নিয়ে কাজ করেছেন এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আইনটি নিয়ে বৈঠক করেছেন— তাদের প্রতিও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি ওই সব কর্মকর্তা অন্য কারও উদ্দেশ্য হাসিল করা বা সরকারের মধ্যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য কাজ করেছেন কিনা, সে বিষয়েও খোঁজখবর নিতে অর্থমন্ত্রী, এনবিআর চেয়ারম্যানের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এদিকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট জটিলতা নিয়ে সংসদে বাজেট আলোচনায় গতকালও তীব্র সমালোচনা হয়েছে। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনি ঢালাওভাবে ভ্যাট ধরেছেন। এই ভ্যাট থেকে কয় টাকা পাবেন। ভ্যাটের আওতা বাড়ান। আর প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে মাসের ২৫ তারিখে ইসিআর মেশিন দিন। ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দিতে বাধ্য থাকবে। ব্যবসার ধরন অনুসারে ভ্যাটের হার নির্ধারণ করুন। ঢালাওভাবে ভ্যাট প্রথা বিশ্বের কোথাও নেই।’ বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভ্যাট আইন নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য চলে গেছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে আমাদের জন্য (দলের) এটা কোনোভাবেই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। এ জন্য আইনটির বাস্তবায়ন আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ভ্যাটের হার কত হলে জনভোগান্তি হবে না এবং ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক হার নির্ধারণ করে স্বল্প সময়ের মধ্যে তাকে অবহিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বাজেটের বিশাল ঘাটতি কমাতে এবং অধিক রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকরের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এ বিষয়টি তিনি গতকালও প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অর্থ বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আইনটি নিয়ে যেহেতু বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে, তাই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে তা আরও পর্যালোচনার নির্দেশনা দিয়েছেন। এনবিআর বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। এক্ষেত্রে আইনটি তৈরিতে যারা জড়িত ছিলেন তাদের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে কোনো অবহেলা থাকলে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সূত্র জানায়, ১ জুন সংসদে বাজেট পেশের পর থেকেই নতুন ভ্যাট আইন আর ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা এ সংকট সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন একাধিকবার। এ জন্য রাজনৈতিক অর্থনীতির অংশ হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী ভ্যাট সংক্রান্ত এই চলমান সংকট সমাধানে আবারও উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাজেট হতে হবে জনকল্যাণের জন্য। শুধু বাজেটের আকার বাড়িয়ে আর করের বোঝা চাপিয়ে জনগণকে চাপে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাবে না। ফলে প্রস্তাবিত বাজেটের বিতর্কিত বিষয়গুলো সমাধান হতে হবে এটি পাসের আগেই। বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী জানতে চান নতুন ভ্যাট আইন দ্রব্যমূল্য বাড়াবে কিনা, জীবন-যাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়বে কিনা—এসব বিষয় অবশ্যই আমলে নিতে হবে। প্রয়োজনে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরির জন্য এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ব্যাংকের আবগারি শুল্কের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, এটা যদি পুরনো বিষয় হয়ে থাকে তাহলে এতদিন সাধারণ মানুষকে জানানো হয়নি কেন? এতে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের দায়িত্বে অবহেলা করেছে কিনা, সে বিষয়েও জানতে চান তিনি। আবগারি শুল্কের হার নির্ধাণের ক্ষেত্রে এক লাখ টাকার ঊর্ধ্বে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা করাকে প্রধানমন্ত্রীও যৌক্তিক মনে করেন না। লেনদেনের এই সীমা আরও বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

সর্বশেষ খবর