শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

সমন্বয়হীন তিন সিটিতে দুর্ভোগ

♦ এক দিনের বৃষ্টিতেই ডুবে যায় ঢাকা
♦ চট্টগ্রামে পানি জমে হাঁটু সমান

নিজামুল হক বিপুল

সমন্বয়হীন তিন সিটিতে দুর্ভোগ

ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এই বর্ষায়ও ভোগান্তি আছে তিন সিটি করপোরেশনের নাগরিক জীবনে। অসময়ে খোঁড়াখুঁড়িই কাল হয়ে দাঁড়াবে তিন সিটির। বিষয়টি মানছেনও নগর পিতারা। তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সমন্বয়ের। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গত ১২ জুন প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে এক দিনেই ডুবে গিয়েছিল রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ এলাকাই তলিয়ে যায় হাঁটু থেকে কোমর পানিতে। একইভাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রধান রাস্তা থেকে শুরু করে অলিগলি তলিয়ে যায়। এ কারণে এই তিন সিটির বাসিন্দাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে চাকরিজীবী থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় কাজে ওই দিন যারা বাসার বাইরে বের হয়েছিলেন তাদের ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানিতে নেমেই চলাফেরা করতে হয়েছে। আর যারা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন তাদের ভোগান্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় তিন সিটি করপোরেশনেই দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রাস্তায় কাটাতে হয়েছে মানুষকে। তীব্র যানজটে আটকে ছিলেন গাড়ি আরোহীরা। অনেক যানবাহন রাস্তায় বিকল হয়ে পড়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, উন্নয়নের নামে বর্ষা মৌসুমে সমন্বয়হীনভাবে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এই তিন সিটি করপোরেশনে প্রতি বছর বর্ষায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এবারও বর্ষার শুরুতে এর ব্যতিক্রম হয়নি। আসন্ন বর্ষা মৌসুম নিয়ে নগরবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এবারও তিন সিটি করপোরেশনের নাগরিকরা ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। অবশ্য নগর পিতারা বলেছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে এক থেকে দুই ঘণ্টায় রাস্তা থেকে পানি নেমে যায়। এই সময়টুকু দিতেই হয়। তবে ভারি বা অতিবৃষ্টিপাত হলে সেই পানি নামতে অনেক সময় লাগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ-সাত ঘণ্টা লাগে। আর তখনই ভোগান্তিটা বাড়ে বেশি। আর ওই সময় সিটি করপোরেশনেরও কিছু করার থাকে না।

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আসার আগে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় বিভিন্ন সেবা সংস্থা তাদের উন্নয়নকাজ শুরু করে। অথবা শুষ্ক মৌসুমে শুরু করা উন্নয়নকাজকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয় বর্ষা মৌসুমে। সিটি করপোরেশনগুলোর সঙ্গে ৫৬টি সেবা সংস্থা কাজ করলেও সরাসরি কাজ করছে ২৬টি সংস্থা। এর মধ্যে ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), তিতাস, ডেসা, ডেসকো, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), ডিপিডিসি, বিটিসিএল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) অন্যতম। হালে যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। আবার ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলার কারণেও তিন নগরীতেই মানুষের ভোগান্তি আছে পদে পদে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্ষায় বৃষ্টিপাতের কারণে নগরীতে জলাবদ্ধতা দেখা দিলে বা পানি জমে গেলে তা দ্রুত নিষ্কাশনের দায়িত্ব হচ্ছে ওয়াসার। কিন্তু ওয়াসা সঠিক সময়ে সঠিক কাজ না করায় এর দায়ভার গিয়ে পড়ে নগর পিতাদের ওপর। যেহেতু তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সে কারণে তারাও চেষ্টা করেন নগরবাসীকে ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে। শেষ পর্যন্ত আর ভোগান্তি থেকে রেহাই পান না নগরবাসী।

সমন্বয়হীনতার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি প্রতিটি সেবা সংস্থাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি কোনো সংস্থা যদি কোনো এলাকায় কোনোরকম খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করে তাহলে আগেই যেন তা সিটি করপোরেশনকে জানানো হয়। তাহলে ওই এলাকায় অন্য আর যে সংস্থার কাজ হবে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার জন্য একটা সমন্বয় করে দেওয়া হবে। কিন্তু চিঠি দেওয়ার পর অনেক সংস্থা এই সমন্বয়টুকু করে না। ফলে একই সড়ক বা রাস্তা একাধিকবার কাটতে হয়। এতে ভোগান্তিও বাড়ে।’ সেবা সংস্থাগুলো যাতে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে সেজন্য তিনি সব চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি তার সিটি করপোরেশন এলাকার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো এলাকায়ই বৃষ্টির পানি জমবে না।’ যে শান্তিনগর এলাকা অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যেত সেখানেও পানি জমার আশঙ্কা খুবই কম দাবি করে মেয়র বলেন, ‘এ এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজব্যবস্থার উন্নতি করা হয়েছে। তাই এবারের বর্ষায় শান্তিনগরে জলাবদ্ধতা ৮৫ ভাগ নিষ্কাশন হয়ে যাবে। একই ভাগে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড থেকে শুরু করে অন্যান্য এলাকায়ও পানি জমার আশঙ্কা নেই। যেসব এলাকায় কিছুটা সমস্যা রয়েছে সেগুলোতে ড্রেনেজব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ চলছে।’ তিনি জানান, ড্রেনেজব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য তার সিটি করপোরেশন ইতালি থেকে একটি অটোমেটিক মেশিন নিয়ে এসেছে। গতকালই এটি দিয়ে ড্রেনের ময়লা পরিষ্কারের কাজ পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের বৈশিষ্ট্য আর অন্য সিটির বৈশিষ্ট্য একই রকম নয়। চট্টগ্রাম শহর পাহাড়-টিলা, নদী আর সাগরবেষ্টিত। তার ওপর শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এখানে পরিকল্পিত ড্রেনেজব্যবস্থা নেই। বৃষ্টির পানি যে ড্রেন থেকে নালা, খাল হয়ে নদীতে যাবে তার কোনো ব্যবস্থা নেই। এর সঙ্গে আবার বৃষ্টির সময় পাহাড়ি মাটি এসে ড্রেনকে ভরাট করে দিচ্ছে।’ চট্টগ্রামের মেয়র বলেন, ‘এসব সমস্যার পাশাপাশি নগরজুড়ে বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি, ফ্লাইওভার নির্মাণ হচ্ছে সমন্বয়হীনভাবে। নগরীতে উন্নয়নকাজে সমন্বয় করার জন্য খুব চেষ্টা করছি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের নিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আলাদা মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ কারণে প্রতিটি প্রকল্পও গ্রহণ করা হয় আলাদাভাবে। এর ফলে সমন্বয়টা হয় না।’ নাছির উদ্দিন বলেন, ‘শহরকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষা করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সমন্বয় নিশ্চিত করা। এজন্য সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তখনই নগরবাসী ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবেন।’ চট্টগ্রামের মেয়র বলেন, ‘বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের কাজ ওয়াসার হলেও চট্টগ্রাম ওয়াসা এত দিন এ কাজ করেনি। বছরখানেক হলো তারা কাজ শুরু করেছে। তারা বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় স্যুয়ারেজ সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে। আমরাও সিটি করপোরেশন থেকে পয়ঃনিষ্কাশনের আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করেছি।’ আসন্ন বর্ষায়ও চট্টগ্রাম নগরবাসীকে ভোগান্তি পোহাতে হবে জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বলেন, ‘এটা বাস্তবতা। এটা মানতে হবে। তবে আগামী বর্ষার আগেই এ সমস্যা সমাধান করা হবে ইনশা আল্লাহ।’ তিনি আরও বলেন, ‘মহেশখালী বাঁধ কেটে দেওয়ার ফলে এবারের বর্ষায় ভোগান্তি কিছুটা কম হবে। পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার একটা সুযোগ হয়েছে। তবে পুরোপুরি শেষ হবে না।’

আর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের দাবি, পানি নিষ্কাশনে কোনো সমন্বয়হীনতা নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন যে অ্যাপ্রোচে পানি নিষ্কাশন করি, তা কর্ডন অ্যাপ্রোচ। অর্থাৎ পাম্পের মাধ্যমে পানি বের করা হয়। এতে সময় লাগে। এ কারণে জলজট তৈরি হয়।’ তবে ঢাকা শহরের পানি ওপেন না কর্ডন অ্যাপ্রোচে নিষ্কাশন করা হবে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অবশ্য ওপেন অ্যাপ্রোচের বিষয়ে মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদিত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর