শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

৬৯ এর আওয়ামী লীগ কোন পথে

রফিকুল ইসলাম রনি

৬৯ এর আওয়ামী লীগ কোন পথে

উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯৪৯ সালের এদিনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে জন্ম নেয় দলটি।  যাত্রার সূচনালগ্মেই বপিত হয়েছিল স্বাধিকার অর্জনে বাঙালির অদম্য সংগ্রামের বীজ। এরপর জাতিগঠন আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে আওয়ামী লীগ। গৌরব ও ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে আজ ৬৯ বছরে পা দিল   হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হকের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দলটির জন্ম মোটেই সুখকর ছিল না। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দলটির নেতা-কর্মীদের নানা জেল-জুলুম-অত্যাচার সইতে হয়েছে। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে কখনো বিরোধী দলে, কখনো সরকারে থেকে দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলটির সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত সাতজন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ সাতবার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তিনবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ দুবার এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও আবদুল মালেক উকিল একবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন একবার দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত করা হয় শেখ হাসিনাকে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নির্বাসনে থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পাহাড়সম শোক বুকে নিয়ে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘরে-বাইরের নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগে বড় ধরনের ভাঙন, তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছেন শেখ হাসিনা শক্ত হাতে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এনেছেন তিনি। এরপর ২০০৮ ও ২০১৪ সালে টানা ক্ষতাসীন হয় দলটি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের কাছে ঐক্য ও আস্থার প্রতীক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেজন্যই তারা উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এ রাজনৈতিক দলটির দায়িত্ব বার বার তুলে দেন শেখ হাসিনার হাতে। নেতৃত্বে শেখ হাসিনার যেমন নতুন রেকর্ড তেমনি দল ও দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

প্রতিষ্ঠালগ্নে নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরে ১৯৫৫ সালে এ দলটি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ’৬৬-এর ছয় দফা এবং ’৬৯-এর গণআন্দোলনসহ দীর্ঘ সংগ্রামের পর ’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি লাভ করে স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। দলটির নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। ৬৮ বছর পূর্তি পবিত্র রমজানের কারণে সাদামাটাভাবে উদ্যাপন করবে আওয়ামী লীগ।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ পাওয়া দলটির প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক ও কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।’ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা সেদিন রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন, তার নাম দেওয়া হল “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ”। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।’

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ’৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ’৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে পঞ্চাশের দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি আবদুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য ’৫৭ সালে দল ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ।

শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। ’৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। ’৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ওই বছরের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি পায়। এর মধ্যে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ’৫৭ সালে দলে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ সময় এই দলটি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে আস্থার স্থান তৈরি করে। ’৬৬ সালে ছয় দফা দেন বঙ্গবন্ধু, যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার ভিত্তিতেই ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দলটির সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন ৭ কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর সামরিক শাসনের নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। নেতাদের মধ্যেও দেখা দেয় বিভেদ। ’৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে কয়েক ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন, আন্দোলন শুরু করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে। তার নেতৃত্বে দলটি তিনবার ক্ষমতায় আসে।

৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মনে প্রশ্ন, কোন পথে আওয়ামী লীগ? টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন দলটি এ মুহূর্তে বেশ নির্ভার। সরকারে বড় ধরনের দুশ্চিন্তাও নেই। তবে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত থাকলেও যে কোনো সময় আবারও অশান্ত হওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করছে? এর উত্তরটা খুব একটা সুখকর নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামী লীগ পূর্ণ এক মেয়াদের পর দেশের ইতিহাসে এই প্রথম টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার সফলতার মুখ দেখলেও সাড়ে আট বছরে সরকার ও আওয়ামী লীগ যেন একাকার হয়ে গেছে। একসময় আওয়ামী লীগ বলতে জাতির সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার সোনালি দিন বোঝাত। সেই আওয়ামী লীগ মহাবিজয় নিয়ে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলেও প্রবল শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রাখতে পারেনি। সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের সাফল্য অভাবনীয় হলেও সাংগঠনিকভাবে অবিন্যস্ত; সারা দেশে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত। এমপি-নেতায় দূরত্ব বাড়ছে যোজন যোজন। দেখা দিয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতাও।

সংগ্রাম ও সাফল্যের ৬৮তম পূর্তিসহ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদ্যাপনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কর্মসূচিতে আছে : আজ সূর্যোদয়ের ক্ষণে কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৯টায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, সাড়ে ৯টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। একই সময়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের নতুন অফিসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। যথাযথ মর্যাদায় দলের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের জন্য সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর