শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভোগান্তির ঈদযাত্রা

ঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোগান্তির ঈদযাত্রা

ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে গ্রামের বাড়িতে ছুটছে রাজধানীবাসী। ভিতরে জায়গা না পেয়ে গতকাল কমলাপুর রেলস্টেশনে এভাবেই ট্রেনের ছাদে উঠে পড়েন অনেক যাত্রী —রোহেত রাজীব

পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা। সকাল থেকেই রাজধানীর বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশন মুখে ছিল যাত্রীর ভিড়। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে অগ্রিম টিকিট সংগ্রহকারীরা গতকাল সকাল থেকেই কমলাপুর রেলস্টেশনে ভিড় করতে থাকেন। কিন্তু কোনো ট্রেনেরই শিডিউল ঠিক ছিল না বলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় অপেক্ষমাণ যাত্রীদের। অন্যদিকে সব থেকে বেশি যাত্রী পরিবহনকারী দূরপাল্লার বাস সার্ভিস আগে থেকে চলাচল করলেও ফেরি পারাপারে সমস্যা হচ্ছে। অন্যদিকে গতকাল শুরু হয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) ঈদ স্পেশাল সার্ভিস। বিশেষ এই নৌ-সার্ভিস চলবে ৩ জুলাই পর্যন্ত। রাজধানী থেকে বেরোনোর মহাসড়কগুলোয় পড়েছে গাড়ির চাপ। এতে মহাসড়কগুলোয় সৃষ্টি হয়েছে অসহনীয় যানজট। ফলে মহা ভোগান্তিতে পড়েছেন ঈদে ঘরমুখো মানুষ। যানজটের পাশাপাশি বৃষ্টি যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। গতকাল শেষ কর্মদিবস হওয়ায় অনেকে গতকালই ঢাকা ছেড়েছেন। মহাসড়কে উন্নয়নকাজ চলায় যানজটের ভয়াবহতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজট। বিশেষ করে রাজধানীর উত্তরা-আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার মহাসড়কে যানজটের অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। সকাল থেকেই টঙ্গী-আবদুল্লাহপুর থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয়েছে মানুষকে। অন্যদিকে ভোগড়া বাইপাস থেকে কোনাবাড়ী হয়ে চন্দ্রা ত্রিমোড় থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার পথও যানজটে স্থবির হয়ে থাকে। এরই মধ্যে ভোগান্তি কমাতে সওজের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

আবদুল্লাহপুর-টঙ্গীতে গাড়ির চাপে টঙ্গী বাজার, বাটা মোড়, স্টেশন রোড, চেরাগ আলী, কলেজ গেট, তারাগাছ, গাজীপুরা, বড়বাড়ী, বোর্ডবাজার, বাসন, চৌধুরীবাড়ী এলাকায় গাড়ির গতি যেন নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ভোগড়া বাইপাস মোড়ে চার রুটের গাড়ির চাপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেমে আছে যানবাহন। বাইপাস থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যেন গাড়ি থেমে রয়েছে। ভোগড়া বাইপাস ও জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার মহাসড়কে চলছে চার লেন উন্নয়নের কাজ। আর এতে ভোগড়া বাইপাস, নাওজোড়, কড্ডা, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, সফিপুর, মৌচাক, পল্লী বিদ্যুৎ, চন্দ্রা হয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত যানজট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে এর তীব্রতা গিয়ে লেগেছে উত্তরা থেকে বিমানবন্দর ও বনানী-মহাখালী পর্যন্ত। আর এতে মহাখালী টার্মিনাল থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পেরোতে লাগছে পাঁচ-থেকে ছয় ঘণ্টা। টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে সিলেট যাওয়ার সড়কে টঙ্গী স্টেশন রোড, টিঅ্যান্ডটি, মাঝুখান, পুবাইল, কালীগঞ্জ ও পুবাইল থেকে কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। মূলত এ পথে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে খানাখন্দ আর বাড়তি যানবাহনের চাপে। গাজীপুর হয়ে কিশোরগঞ্জ সড়কের গাড়ির চাপ তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা থেকে কাপাসিয়া হয়ে কিশোরগঞ্জ সরু রাস্তা হওয়ায় এবং স্থানে স্থানে ছোট সরু সেতু থাকায় এ সড়কের গাড়ি থেমে থেমে চলছে। ঢাকা থেকে সিলেট ও চট্টগ্রাম যেতে গাড়িগুলোকে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকতে হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ও ভুলতায়, যেখানে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলছে। খানাখন্দভরা সড়কের কারণে সিলেটমুখী যাত্রীদের যানজটের ধকল পোহাতে হচ্ছে নরসিংদীর ঘোড়াশালে। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর সেতু পেরিয়ে যাওয়ার পরপরই বাঁ দিকে সিলেট মহাসড়ক, আর সোজা চলে গেছে চট্টগ্রাম মহাসড়ক। নাজুক কাঁচপুর সেতুতে নিত্য সময় যানজট লেগে থাকায় সিলেটগামী অনেক বাস ডেমরা সেতু হয়েই রাজধানী ছাড়ে। তবে কাঁচপুর সেতু হয়েও যায় অনেক বাস। সেখানে দীর্ঘ যানজট পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। গর্ত-জলাবদ্ধতার কারণে যাত্রাবাড়ী হয়ে পূর্বাঞ্চলের যাত্রাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ৪০টি জেলায় যাতায়াতে গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের আগে-পরে যানজট দেখা দিয়েছে। এ পথের মূল সমস্যা অব্যবস্থাপনা ও যানবাহনের এলোমেলো চলাচল। এ রুটে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় যাওয়ার পথে আমিনবাজার সেতু পার হওয়ার পর ঢাকামুখী পথে তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। এই জট গাবতলী থেকে আট কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। আর এ জট এসে লেগেছে কল্যাণপুর পর্যন্ত। অতিরিক্ত গাড়ির চাপে ঢাকা-আরিচা, নবীনগর-কালিয়াকৈর ও আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কেও যানজট দেখা গেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগস্থল পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটেও দেখা দিয়েছে ভয়াবহ যানজট।

টাঙ্গাইলগামী বাসের যাত্রী মেহেরুন বলেন, ‘বাড়ি যাব ঈদ করতে। ঈদের বাকি এখনো তিন দিন। এর পরও সড়কে আটকে আছি।’ কুড়িগ্রামের মিজানুর বলেন, ‘ভাই, কী করব। চিন্তা করেছি বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করব। ছোট্ট শিশু বাচ্চাকে নিয়ে যানজটে আটকে থেকে মহা যন্ত্রণায় আছি। ঢাকা থেকে বের হতেই এ অবস্থা। না জানি কপালে কী আছে আজ!’ বাসচালক মানিক বলেন, ‘মহাখালী থেকে ভোগড়া বাইপাস পর্যন্ত আসতে চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়। রংপুরে গিয়ে আজ আর ফেরা যাবে না।’ তীব্র যানজট থাকায় শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ইলিয়াস নামের এক চাকরিজীবী হেঁটে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই, উত্তরা থেকে কোনাবাড়ী পর্যন্ত আসতে পাঁচ ঘণ্টা লেগেছে। আর পারছি না। তাই নেমে হাঁটা শুরু করলাম। দেখা যাক কত দূর যেতে পারি।’ পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানান, গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এবং এগুলোর আশপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন ১০ হাজারের মতো দূরপাল্লার বাস চলাচল করে। ঈদে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। এসব বাসের একটা বড় অংশই সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যে আসা-যাওয়া করে। ফলে ওই সময় যানজট আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। ঈদের আগে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবহনসংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশের মেঘনা সেতু থেকে ভবের চর পর্যন্ত উভয় পাশের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। বুধবার রাত থেকেই এ রুটে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে ধীরগতিতে চলতে দেখা যায় যানবাহন। কখনো কখনো মেঘনা সেতু থেকে মেঘনা-গোমতী সেতু পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেখা যায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি। গজারিয়া হাইওয়ে পুলিশফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ হাসেম মুন্সী জানান, ঈদ সামনে রেখে মহাসড়কে প্রচুর যানবাহন থাকায় জটের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগও বেড়েছে। তবে যানজট নিরসনের চেষ্টায় তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন এ পথের যাত্রী ও চালকরা। তাদের দাবি, তল্লাশির নামে প্রতিটি গাড়িকে ২০ থেকে ২৫ মিনিট দেরি করানোর ফলে যানজট বাড়ছে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যাচ্ছে।

ঈদে ঘরমুখো মানুষের অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে ডবল ট্রিপ (স্পেশাল সার্ভিস) শুরু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যার পর ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল থেকে নিয়মিত সার্ভিসের ছয়টি লঞ্চের সঙ্গে স্পেশাল সার্ভিসের আরও তিনটিসহ মোট নয়টি লঞ্চ যাত্রী বোঝাই করে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের ভিড়, লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। লঞ্চে ও স্পিডবোটে তুলনামূলক যাত্রীর চাপ বেশি। তবে ফেরিতে এখনো পরিবহনের চাপ সহনীয় রয়েছে। লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। বিআইডব্লিউটিসিসহ একাধিক সূত্র জানায়, গতকাল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের স্বল্প দূরত্বের এ রুটে লঞ্চ ও স্পিডবোট হয়ে ঘরমুখো যাত্রীর ভিড় বাড়তে শুরু করে। শিমুলিয়া থেকে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ফেরিতে চড়ে যাত্রীরা কাঁঠালবাড়ী ঘাটে আসেন। স্পিডবোটগুলো যাত্রীপ্রতি ১২০ টাকার ভাড়া ১৫০ টাকা নিচ্ছে। পদ্মা নদী পার হয়ে কাঁঠালবাড়ী ঘাটে এসে যাত্রীরা পড়ছেন চরম বিপাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর