রবিবার, ২৫ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

কেনাকাটায় চাঙ্গা অর্থনীতি

প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

দৃশ্যপট ০১ : রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে বসবাসরত রিকশাচালক মুখলেসের হাতে বেশ কয়েকটি ব্যাগ। এগুলো নিয়ে তিনি মহাখালী যাচ্ছেন বাড়ি যাওয়ার গাড়ি ধরতে। জিজ্ঞেস করতে জানালেন, ব্যাগের ভিতর তার ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর জন্য কিছু পোশাক কিনে নিয়েছেন। সব পোশাকই কিনেছেন তিনি ফুটপাথ থেকে। এতে তার প্রায় তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

দৃশ্যপট ০২ : বেসরকারি চাকরিজীবী সাইদুল আমিন রাজধানীর একটি বৃহত্তম শপিং মল থেকে শপিং করে ফিরছেন। ফার্মগেটে মিরপুরগামী একটি বাসে তার সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানান, প্রায় ৪০ হাজার টাকার কেনাকাটা করেছেন তিনি। স্ত্রী, ছোট দুই ছেলে-মেয়ে, মা, ছোট ভাই এবং পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের জন্য এসব জিনিস কিনতে তিনি বোনাসের পুরো টাকাটাই ব্যয় করেছেন।

ধনী থেকে দরিদ্র সব শ্রেণির মানুষ নিজেদের সাধ্যমতো প্রয়োজনের পণ্যটি এমনভাবেই কিনে নিচ্ছেন। রোজার ঈদকে সামনে রেখে তাই দেশের অর্থনীতিতেও চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে। যদিও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এ বছর পার্শ্ববর্তী দেশের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করায় ক্রেতাদের একটি বড় অংশ কলকাতায় কেনাকাটা করেছেন। তারপরও ঈদকে কেন্দ্র করে দেশে কেনাকাটার পরিমাণ প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে বলে তারা মনে করছেন।

এ ব্যাপারে এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি ও পরিচালক এবং দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীন বলেন, গতবারের তুলনায় এবার আর্থিক লেনদেন কিছুটা কম হতে পারে। কারণ উন্মুক্ত ভিসা পদ্ধতির কারণে প্রচুর মানুষ ভারতে যাচ্ছে কেনাকাটা করতে। এই ঈদে কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষ ভারতে গেছে ঈদ কেনাকাটা করতে। মাথাপিছু এক হাজার ডলার করে কেনাকাটা করছে। সে হিসাবে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হবে। এ টাকাটা দেশের ভিতর থাকলে অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হতো। ্লঈদকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি খাত থেকে অর্থনীতিতে অতিরিক্ত অর্থ যুক্ত হয়। এর মধ্যে রয়েছে— সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী এবং আরও প্রায় ৩০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের বেতন ও বোনাস, যা ঈদ অর্থনীতিতে আসছে। এ ছাড়া আরও রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকা। ঈদের সময়ে প্রবাসীরা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বাড়তি ব্যয় মেটাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, মে মাসে ১২৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর চলতি জুন মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ৭২ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। ঈদকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি গতি যোগ করছে।

রোজার মাসজুড়েই ভিড় ছিল শপিং মল ও দোকানপাটে : রাজধানীতে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম শপিং মল বসুন্ধরা সিটি ও যমুনা ফিউচার পার্ক, নিউমার্কেট, গুলশান মার্কেট, উত্তরার মাসকট প্লাজা, গাউছিয়া, চাঁদনী চক, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, বেইলি রোড, ইস্টার্ন প্লাজা, বায়তুল মোকাররম, পলওয়েল মার্কেট, মৌচাক, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি, পুরান ঢাকার ইসলামপুর এবং শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট থেকে শুরু করে ফুটপাথ পর্যন্ত সবখানেই ঈদের কেনাকাটা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর আলোকসজ্জায় সজ্জিত বসুন্ধরা সিটিতে রোজার প্রথম দিক থেকেই দেখা গেছে ক্রেতাদের ভিড়। প্রতিটি লেভেলের দোকানেই ছিল কেনাকাটার ব্যস্ততা। একটি স্থানে প্রয়োজনের প্রায় সব পণ্য পাওয়া গেছে বলে অনেকে নির্ঝঞ্ঝাট কেনাকাটা করতে বসুন্ধরা সিটির মতো শপিং মলকেই বেছে নিয়েছেন। রাজধানীর শপিং মল ও বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, এবারের ঈদ মার্কেটে বরাবরের মতোই ফ্যাশনের বাড়তি আবহ সৃষ্টি করেছে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর নিজস্ব সৃষ্টিকর্ম। অঞ্জনস, ট্রেনডস, দর্জিবাড়ি, দেশি দশের মতো নানা ফ্যাশন হাউসে তরুণ-তরুণী ক্রেতাদের ভিড় করতে দেখা গেছে। এর বাইরে বিভিন্ন মার্কেটে ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, চীন, ইতালিসহ ইউরোপ ও আমেরিকার পণ্যের চাহিদাও দেখা গেছে ক্রেতাদের মধ্যে। তবে মেয়েদের থ্রি-পিস, লেহেঙ্গা আর শাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ভারতীয় পোশাকের চাহিদা বেশি দেখা গেছে। এসব পণ্যের নামও ছিল ভারতীয় জনপ্রিয় সিরিয়াল আর হিন্দি চলচ্চিত্রের নামানুসারে।  উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কেনাকাটা বিভিন্ন শপিং মল ও মার্কেট থেকে হলেও দরিদ্র শ্রেণির জন্য ফুটপাথই ভরসা। প্রতি বছর মতিঝিল থেকে গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররমের সামনের রাস্তা, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তার পাশে ফুটপাথে প্রচুর বেচাকেনা হয়। এবারও বায়তুল মোকাররমের আশেপাশে পাঞ্জাবি, টুপি, তসবিহসহ ঈদের প্রয়োজনীয় নানা পণ্য নিয়ে বসেছে দোকানিরা। তবে এবার রোজার মাসজুড়ে অতিবৃষ্টি এবং মতিঝিল ও গুলশান এলাকায় হকারদের বসতে না দেওয়ার কারণে আগের মতো ব্যবসা হয়নি বলে জানিয়েছেন সেখানকার ফুটপাথ দোকানিরা। রোজার ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর ইসলামপুরেও ছিল ক্রেতাদের ভিড়। প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ কোটি টাকার কাটা কাপড়ের ব্যবসা হয় এই বাজারে। ঈদের আগে কখনো কখনো তা শত কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায় বলে জানিয়েছেন ওই এলাকার ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে যারা নিজের পছন্দমতো পোশাক বানিয়ে নিতে চান তারাই ভিড় করেছেন ইসলামপুর বাজারে।  দোকানপাট ছাড়াও ঈদকে কেন্দ্র করে অনলাইনে ব্যবসাও (ই-বিজনেস) বেড়েছে। সামাজিক মাধ্যমের সাইটগুলোতে ঢুকলেও দেখা গেছে নানারকম পণ্যের ছবিসহ বিজ্ঞাপন। এর মধ্যে শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, জুতা, ঘড়ি, সানগ্লাস, বেল্ট, মোবাইল ফোনসহ নানা ধরনের পণ্য বিক্রি হয়েছে।

ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আল হাই রেজাউল ইসলাম মন্টু বলেন, গতবার ঈদের পর আমরা এফবিসিসিআই থেকে হিসাব করে দেখেছিলাম যাতে মোট কেনাকাটার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে এ বছর প্রথম দিকে বৃষ্টি-বাদলের কারণে তেমন একটা কেনাকাটা হয়নি। একটি অংশ আবার কলকাতায় কেনাকাটা করেছে। তারপরেও শেষদিকে আবহাওয়া ভালো থাকায় বেচাকেনা ভালো হচ্ছে। আমরা বিভাগীয় শহর ছাড়াও জেলা শহরের মার্কেটগুলোতে খোঁজ নিয়েছি। সারা রাত বেচাকেনা হচ্ছে। আশা করছি আগের ঈদের চেয়ে এবার ৫ শতাংশ বেশি বিক্রি হবে। ঈদকে কেন্দ্র করে এবারের মোট কেনাকাটার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকার মতো হতে পারে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

সর্বশেষ খবর