বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভ্যাট-যন্ত্রণা মুক্ত করলেন প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

অবশেষে ভ্যাট সমস্যার সমাধান হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে। ব্যাপক সমালোচনা আর তীব্র বিরোধিতার মুখে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ভ্যাট আইন, ২০১২ বাস্তবায়ন আগামী দুই বছর স্থগিত রেখে এবং গ্রাহকদের ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের ওপর আরোপিত আবগারি শুল্কের হার কমিয়ে এনে জাতীয় সংসদে অর্থবিল, ২০১৭ পাস করা হয়েছে। এতে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেলেন ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হতে পারে এ কথা আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনার সময় নতুন এই ভ্যাট আইন আগামী দুই বছর স্থগিত রেখে পুরনো ভ্যাট আইন, ১৯৯১ বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। দীর্ঘ প্রায় এক মাস আলোচনার পর বেশ কয়েকটি সংশোধনী এনে বিলটি সংসদে কণ্ঠভোটে পাস করা হয় গতকাল। এর আগে ১ জুন সংসদে বাজেট উপস্থাপনের সময় বিলটি উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।

পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটির পর গতকাল বিকাল ৪টায় বাজেট অধিবেশনের শুরুতে বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরপর বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং তার পরই বাজেট বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি বাজেট নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে সেসব বিষয়ের খুঁটিনাটি তুলে ধরেন। বক্তব্যের শেষ দিকে এসে ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের ওপর আরোপিত আবগারি শুল্ক কমানো এবং নতুন ভ্যাট আইন, ২০১২ আগামী দুই বছর বাস্তবায়ন স্থগিত রাখার পরামর্শ দেন অর্থমন্ত্রীকে। পরে অর্থমন্ত্রী তার সমাপনী বক্তব্যে এসব ঘোষণা দেন।

অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, আবগারি শুল্কহার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য প্রযোজ্য হবে এমন—১ লাখ টাকা পর্যন্ত শূন্য টাকা, ১ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা,  ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫০০ টাকা, ১০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ২৫০০ টাকা, ১ কোটি টাকা  থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ১২ হাজার  টাকা এবং ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে ২৫ হাজার টাকা। প্রস্তাবিত অর্থবিল, ২০১৭-এর ওপর ২৮টি সংশোধনীতে ৯৪টি প্রস্তাব আসে। এর মধ্যে চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এগুলো নিয়ে সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা বক্তব্য তুলে ধরেন। অর্থবিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব সমাপনী হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ইমন, নুরুল ইসলাম মিলন, পীর ফজলুর রহমান মেজবাহ, শহীদুজ্জামান সরকার ও মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তার কয়েক মেয়াদে নেওয়া নানা পদক্ষেপের ফলে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তিনি আগামী অর্থবিল, ২০১৭-তে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ করেন। এর মধ্যে নতুন ভ্যাট আইনটি দুই বছরের কার্যকর না করা, ব্যাংক সঞ্চয়ের ওপর আবগারি শুল্ক হারে পরিবর্তন আনা এবং চাল আমদানিতে শুল্ক হারে পরিবর্তন আনা।

নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ব্যবসায়ীরা তাতে সাড়া দিচ্ছেন না। এ জন্য আগামী দুই বছর বিদ্যমান পদ্ধতিতেই ভ্যাট দেবেন। এ জন্য বর্তমান পদ্ধতিতেই আগামী দুই বছর ভ্যাট আদায় অব্যাহত রাখার  অনুরোধ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কর আরোপ প্রক্রিয়ায় মূল্য সংযোজন কর একটি উত্তম পন্থা। ১৯৯১ সালে প্রণীত মূল্য সংযোজন কর আইনটি বহু সংশোধনীর পর অফলপ্রসূ হয়ে পড়ায় ২০০৮ সালেই একটি নতুন মূসক আইন প্রণয়ন করা হয়। এটি নিয়ে প্রায় চার বছর আমরা নানা আলোচনা-বিতর্ক চালিয়ে যাই। অবশেষে ২০১২ সালে আমরা নতুন আইন প্রণয়ন করি, যা মহান সংসদে পাস হয়। এ আইনটির কার্যকারিতা কিন্তু ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে। এ বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এ জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে আইনটি কার্যকর করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ বিষয়ে সংসদ সদস্যরা মতামত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে আমি মূসক আইনের পূর্ণ কার্যকারিতা পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করছি।’

এ সময় তিনি বলেন, ‘আগের ধারাবাহিকতায় কিছু সংশোধন করে ২০১২ সালের আইনটি যেভাবে চার বছর ধরে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে ঠিক তেমনি আমাদের বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে।’

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ও নির্দেশনায় মেডিটেশনকে আগামী দুই বছর ভ্যাটমুক্ত রাখেন অর্থমন্ত্রী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে একটি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম হিসেবে আমরা বিবেচনা করব।’ এ ছাড়া কম্পিউটার, সেলুলার ফোন এবং এর যন্ত্রাংশকে মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অন্যদিকে শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের বিদ্যমান কর সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। মোটরসাইকেল শিল্পের ওপর স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আরোপিত সমুদয় মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মাইক্রোসফট বাংলাদেশ লিমিটেডের সফটওয়্যার আমদানিতে যেসব পণ্যে আমদানি শুল্ক নেই সেগুলোকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংযোজনকারীদের ওপর প্রযোজ্য ৩০ শতাংশের স্থলে ২০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। এলপিজি কনটেইনারের ওপর আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে লোহার এলপিজি কনটেইনারের ওপর ভ্যাট বহাল রাখা হয়েছে।

মোটরসাইকেলের সব যন্ত্রপাতি উৎপাদনকে সাহায্য করার জন্য গত বছরের অর্থবিলে প্রগ্রেসিভ উৎপাদনকে কিছু কর/শুল্কের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অগ্রগতি না থাকায় সেটি বাদ দেওয়া হয়। শিগগিরই উদ্যোক্তারা উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করবেন এবং সেই বিবেচনায় এর ওপর বর্ধিত শুল্ক করাদি মওকুফ করার  করা হয়।

এ ছাড়া জাপান দূতাবাস ও নিটোল নিলয় কোম্পানি অদূর ভবিষ্যতে হোন্ডা এবং অন্যান্য কোম্পানি মোটরসাইকেল ও মোটরগাড়ির উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করবে। সেই বিবেচনায় প্রয়োজনীয় উপকরণের ওপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। সোলার প্যানেলের ওপর প্রস্তাবিত আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তৈরি পোশাক খাতে উেস কর ১ শতাংশ বহাল থাকবে। তবে সবুজ কারখানার ক্ষেত্রে আয়কর হার ১০ শতাংশ এবং অন্যদের ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। সিগারেট কোম্পানির কর ব্যবস্থার জটিলতা নিরসনে এসআরও জারি করে নিষ্পত্তি করা হবে। এসআরও জারির আগ পর্যন্ত ১ জুন প্রস্তাবিত হার বহাল থাকবে। গ্লাসওয়্যার পণ্যের ওপর দেশীয় শিল্পসহায়ক শুল্ককাঠামোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে। একইভাবে গুঁড়া মসলাজাতীয় মরিচ, হলুদ, ধনিয়া এগুলোর ট্যারিফ মূল্য বহাল রেখে ভ্যাটের হার নির্ধারণ করা হবে। ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে নতুন এই অর্থবিল, ২০১৭। আজ জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট পাস হবে।

সর্বশেষ খবর