বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঈদে বেহাল স্বাস্থ্যসেবা

আলী আজম ও জয়শ্রী ভাদুড়ী ঢাকা; নিজস্ব প্রতিবেদক রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর ও বরিশাল

ঈদুল ফিতরে এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসক ও নার্স ছুটিতে থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন জরুরি বিভাগের রোগীরা। দেশের অধিকাংশ হাসপাতালেই ছুটির আমেজে তৈরি হয়েছে রোগীদের ভোগান্তি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে সেবা নিতে এসে রোগীদের পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। শুধু রাজধানী নয়, দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও প্রমাণ মিলেছে জরুরি সেবায় ভোগান্তির। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ছিলেন ছুটিতে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক স্বল্পতা ও সেবায় অবহেলা ছিল চরমে। চিকিৎসা না পেয়ে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছেন ২০৫ জন রোগী। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০০ চিকিৎসকের মধ্যে ২৫০ জনই ছুটিতে যাওয়ায় নার্সদের দিয়ে চলেছে চিকিৎসা। যারা উপস্থিত আছেন তাদেরও প্রয়োজনে পাচ্ছেন না রোগীরা। তবে হাসপাতালের পরিচালকদের দাবি, চিকিৎসক কম থাকলেও চিকিৎসাসেবায় কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটেনি। ঈদের আগের দিন রাত ১১টার দিকে গাজীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) আসেন রবিউল হোসাইন। দুর্ঘটনায় বাঁ পায়ে প্রচণ্ড আঘাত লেগে থেঁতলে গেছে মাংস। রাত ১২টার দিকে যখন তাকে হাসপাতালে আনা হয়, ডাক্তার না থাকায় ওই অবস্থায় কেটে যায় ঘণ্টাখানেক। পরে নার্সরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে ভর্তি করিয়ে নেন। পরদিন ডাক্তার এলে শুরু হয় চিকিৎসা। পঙ্গু হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকায় এবং ছুটি নেওয়ার কারণে তৈরি করা হয়েছে চিকিৎসক-নার্সদের বিশেষ কর্মতালিকা বা রোস্টার। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা আবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা করে তৈরি করা হয়েছে দুটি শিফট। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অধিকাংশই ছুটিতে থাকায় অন্য ধর্মাবলম্বীদের দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। পঙ্গু হাসপাতালে সব মিলিয়ে ১২৮ জন চিকিৎসকের মধ্যে ২৫ থেকে ২৮ জুন কর্মরত ছিলেন ৪৮ জন। আর প্রায় ৬০০ নার্সের মধ্যে কর্মরত ছিলেন ১১২ জন। হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি খন্দকার রফিক বলেন, ‘গত সপ্তাহে কোমরে আঘাত পাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হই। চিকিৎসা শুরু হলেও ঈদের আগের দিন থেকে ডাক্তাররা কম আসছেন। নার্সরা অনেক সময় দেখে দিচ্ছেন। একজন ডাক্তার থাকায় ওয়ার্ড ঘুরে আসতেই অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে রোগীদের তিনি সময় দিচ্ছেন কম।’ তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ওয়ার্ডের দায়িত্বরত ডাক্তার বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত কাজ করছি, যাতে করে সেবায় কোনো কমতি না থাকে। দিনে নির্ধারিত সময়ে রাউন্ডগুলো দেওয়া হচ্ছে। রাতেও দায়িত্বরত চিকিৎসক উপস্থিত থাকছেন।’ শুধু পঙ্গু হাসপাতাল নয়, আরেকটি বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেও জরুরি বিভাগে দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। ঈদের দিন রাতে হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসেন টাঙ্গাইলের আলিম হোসেন। কিন্তু চিকিৎসা শুরু করতে লেগে যায় বেশ কিছুক্ষণ। পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসে চিকিৎসা দেন তাকে। হৃদরোগ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অধ্যাপক ১৫ জনের মধ্যে ঈদের ছুটিতে ছিলেন সাতজন, চিকিৎসকদের ৯৫ জনের মধ্যে ঈদের ছুটিতে ছিলেন ৬৫ জন এবং ৯০৯ জন নার্সের মধ্যে ছুটিতে ছিলেন ৬৪৯ জন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে উপস্থিত চিকিৎসকদের আলাদা তালিকা তৈরি করা হয়েছে বলে জানান হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. আফজালুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ঈদের ছুটির কারণে যেন ভোগান্তি না হয় এ জন্য আমি নিজে তদারক করেছি। ২৫ থেকে ২৮ জুন আমরা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অন্য ধর্মাবলম্বীদের সহযোগিতায় নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে গেছি।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোস্টারে চিকিৎসকের তালিকা থাকলেও ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা মেলেনি তাদের। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল ১০টা পার হলেও এখনো রাউন্ডে আসেননি চিকিৎসকরা। জরুরি বিভাগে ভর্তি থাকা রেজাউল করিম বলেন, ‘ঈদের দিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। এ রকম আমার মতো আরও বেশ কয়েকজন রোগীই সিরিয়ালে ছিল।’ একজন মাত্র ডাক্তারের এত রোগী নিয়ে হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। দেশের অন্যতম প্রধান এই হাসপাতালে অন্য হাসপাতালের তুলনায় রোগীর চাপও ছিল বেশি। হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিনিয়র ডাক্তারদের অধিকাংশ ছুটিতে থাকলেও জুনিয়রদের অর্ধেকেরও বেশি উপস্থিত ছিলেন। এর পরও রোগীর তুলনায় সে সংখ্যা নগণ্য। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, ঈদের বন্ধে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে এক মাস আগ থেকে পরিকল্পনা করা হয়। কার কখন কোথায় ডিউটি তা ঠিক করা হয়। দফায় দফায় সভা করা হয়। গঠন করা হয় মনিটরিং টিম। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের আউটডোরে রোগীদের দীর্ঘ সিরিয়াল থাকলেও দেখা মেলেনি চিকিৎসকের। জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাত্র একজন ডাক্তার দায়িত্ব পালন করছেন। সিরিয়াল পড়ছে ছয়-সাতজন রোগীর। অবজারভেশন রুমে ছিলেন মাত্র একজন নার্স। সেখানে রোগীর সংখ্যা ছিল সাতজন। এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্রায়ান বঙ্কিম হালদার বলেন, ‘ঈদের বন্ধে রোগী বা তাদের স্বজনদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি। ঈদের দিন আউটডোর বন্ধ থাকলেও ইমার্জেন্সি ও ক্যাজুয়ালটি বিভাগ খোলা ছিল। ডাক্তার কম থাকলেও চিকিৎসাসেবায় কোনো হেরফের হয়নি।’ রাজধানীর মতো দেশের অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও দেখা মিলেছে রোগী ভোগান্তির।

নিজস্ব প্রতিবেদক রাজশাহী জানান, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) ঈদের ছুটিতে চিকিৎসায় ভরসা ছিলেন ইন্টার্নরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ছুটিতে থাকায় ইন্টার্নরা দায়িত্ব পালন করেছেন। হাসপাতালের ৮ ও ৩১ নম্বর এবং শিশু ওয়ার্ডে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও দেখা মেলেনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রফিকুল ইসলাম বলেন, ঈদের ছুটিতেও সবাইকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রয়োজনমতো চিকিৎসক, নার্স সবাই ছিলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অধীনে ২৫৭ জন এমবিবিএস এবং কলেজের অধীনে ২৪৩ জন চিকিৎসক আছেন। এর মধ্যে ঈদের ছুটিতে ছিলেন প্রায় অর্ধেক। ফলে রোগীদের ভোগান্তি ছিল চরমে। চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ঈদের তিন দিন বন্ধে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৬ জন রোগী মারা গেছেন। এর মধ্যে ২৫ জুন মারা যান ২৯ জন। ওই দিন মোট রোগী ছিলেন ১ হাজার ৬৯২ জন। নতুন ভর্তি হন ৩৩৭ জন। ২৬ জুন মারা যান ২৪ জন। নতুন ভর্তি হয় ৩৮৯ জন। মোট ভর্তি ছিলেন ১ হাজার ৯৭০ জন। ২৭ জুন মারা যান ২৩ জন। নতুন ভর্তি হন ৪৬৪ জন। মোট ভর্তি ছিলেন ১ হাজার ৯৭০ জন। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, ওয়ার্ডের নার্সরা দায়িত্বরত অবস্থায় রোগীর নানা সেবার বিষয়ে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করেন না। ওয়ার্ডে নার্সরা উপস্থিত থাকার পরও আয়া বা ওয়ার্ডবয় দিয়ে ইনজেকশন পুশ, স্যালাইন দেওয়াসহ নানা কাজ করিয়ে থাকেন। চমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. দিদার উল আলম বলেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালে রোগীর তুলনায় চিকিৎসক-নার্স সংকট চরমে। তবে ঈদসহ বিভিন্ন সময় আমরা রোস্টার ডিউটির মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করি।’

নিজস্ব প্রতিবেদক বরিশাল জানান, ঈদের বন্ধের গত চার দিনে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন ২০৫ জন রোগী। চার দিনে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ৮৭ জন রোগীকে। প্রত্যাশিত চিকিৎসা না পেয়ে এই সময়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন সাতজন রোগী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫০০ শয্যার শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪১টি ওয়ার্ডে গড়ে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে দেড় হাজারের বেশি। এ ছাড়া ২৭টি বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন চিকিৎসা নেন পাঁচ হাজারেরও বেশি রোগী। এ কারণে প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ার অভিযোগ রোগীদের নিত্যদিনের। ঈদের বন্ধে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীর উপস্থিতি কম থাকায় বেড়েছে রোগী ও তাদের স্বজনদের অভাব-অভিযোগ। যদিও সার্বিকভাবে হাসপাতাল পরিচালনায় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি বলে জানিয়েছেন শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এস এম সিরাজুল ইসলাম।

নিজস্ব প্রতিবেদক রংপুর জানান, অধিকাংশ চিকিৎসক ঈদের ছুটিতে থাকায় রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন চিকিৎসাধীন রোগীরা। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টায় ৯ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, হোসনে আরা নামে এক মহিলা একবার নার্সদের কক্ষে, আরেকবার রোগীর বেডে ছুটে যাচ্ছেন। সমস্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন আমার মেয়ে সন্তান প্রসব করেছে। মঙ্গলবার সকালে একজন ডাক্তার এসে দেখে গেছে। সন্ধ্যার পরে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে কিন্তু ওয়ার্ডের কর্তব্যরত ডাক্তারের কক্ষে তালা ঝুলছে।’ রমেক হাসপাতাল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে সব মিলিয়ে ৩০০ চিকিৎসক কর্মরত থাকেন। এর মধ্যে ২৫০ জনই চলে গেছেন ঈদের ছুটিতে। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, রোগীদের যে ভোগান্তি হচ্ছে না তা অস্বীকার করা যাবে না। চিকিৎসক সংকটের কারণে সমস্যা তো হচ্ছেই।

চিকিৎসকদের ধন্যবাদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর : ঈদের ছুটিতেও কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ায় চিকিৎসক ও নার্সদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেন, ‘ঈদের ছুটিতেও দেশের হাসপাতালগুলোয় সেবায় কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে চিকিৎসক ও নার্সরা মানুষের সেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। এই সেবা অব্যাহত রাখলে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সফল হবেই।’ গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ঈদ-পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময় সভায় এসব কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সভায় সভাপতিত্ব করেন তিনি। চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালের কর্মচারীরা পালাক্রমে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করায় রোগীরা অব্যাহত সেবা পেয়েছেন বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর