রবিবার, ২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

উত্তরাঞ্চলে মাদকের হোম সার্ভিস ফোন করলেই ঘরে পৌঁছে যায়

গোলাম রাব্বানী ও শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

উত্তরাঞ্চলে মাদকের হোম সার্ভিস ফোন করলেই ঘরে পৌঁছে যায়

রংপুর মহানগরসহ উত্তরাঞ্চলের গ্রাম-গঞ্জের তরুণ-তরুণীরা এখন আসক্ত হচ্ছে মরণনেশা ইয়াবায়। এগুলো ‘বাবা’, ‘ছোট’ ও ‘গুটি’ নামে পরিচিত। রংপুর অঞ্চলে পাইকারি বিক্রেতার হাত হয়ে তা যাচ্ছে খুচরা বিক্রেতার কাছে। খুচরা বিক্রেতারা দিচ্ছেন ‘হোম সার্ভিস’। ফোন করলেই বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এই মাদক। আর মাদকের সেলসম্যানের ভূমিকায় রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা।

শুধু বাবা নয়, হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মরণনেশা ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, বাংলামদ, ড্যান্ডি, বিভিন্ন জাতের মিশ্রণে তৈরি ঝাক্কি-১. ঝাক্কি-২, মিকচার-১সহ নানা ধরনের মাদক। তবে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা এখন বেশি জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবায়। মাদকে আসক্ত হচ্ছেন একশ্রেণির পুলিশ সদস্য, মাঝবয়সী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ফেনসিডিলের পরিবর্তে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনের পরিমাণ উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নেশা। এর ফলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। মাদকের নিষ্ঠুর পদাঘাতে কেউ লাখ লাখ টাকার ব্যবসা ধ্বংস করে সর্বস্বান্ত; কেউবা জড়িয়েছেন ভয়ঙ্কর অপরাধ চক্রে। পরিবার তছনছ হয়ে গেছে কারও কারও। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, মাদকাসক্তের শতকরা ২৫-৩০ ভাগই এখন ইয়াবাসেবী। পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও সেবন প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় দ্রুত ইয়াবার বিস্তার ঘটছে। মাদক কারবারিদের এ দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে, এসব প্রতিরোধ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। জানা গেছে, রংপুরের প্রধান চার-পাঁচ জন মাদক ব্যবসায়ী রাজশাহীর চরাঞ্চল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হিলি, পলাশবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, হারাগাছ, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তপথে মাদক নিয়ে আসেন। অভিযোগ রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশ, এলাকার সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক দলের নেতা, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাসোহারা দিয়ে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রংপুরে ফেনসিডিল ও গাঁজার বড় চালান আসছে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর সীমান্ত দিয়ে। এ তিনটি জেলার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে ভারতের সঙ্গে। আর ইয়াবার বড় চালান আসছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে। রংপুর মহানগরের খামারপাড়া, বনানীপাড়া, আলমনগর, বাবুপাড়া, রেলওয়ে স্টেশন, মডার্ন মোড়, পার্কের মোড়, কলেজপাড়া, আশরতপুর, পুরাতন ট্রাকস্ট্যান্ড, চকবাজার, জলকর, খটখটিয়া, হনুমানতলা, হাজীর হাট, মেডিকেল কলেজ মোড়, মেডিকেল পূর্বগেট, দর্শনা মোড়, ভুরারঘাট, বুড়িরহাট, সাহেবগঞ্জ, সাতমাথা, মাহিগঞ্জ আমতলা এবং সদর উপজেলার বৈরাগীগঞ্জ, দমদমা, কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ, মলনবাজার, গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর, উপজেলা সদর, পীরগাছা বাজার এবং পীরগঞ্জ উপজেলা সদর, কাচদহ, দুধিয়াবাড়ী ও ভেন্ডাবাড়ী, চতরা, মদারগঞ্জ মাদক কেনাবেচার প্রধান কেন্দ্র। এ ছাড়া হারাগাছ পৌর এলাকার সবচেয়ে বেশি মাদক বিক্রি হয় সারাই বাজার, চাঁদনি বাজার, আমবাগান, জয় বাংলা মোড়, ভিতরকুঠি, বানুপাড়া, চতুরা, দরদি বাজার, মায়া বাজার, মেনাজ বাজার, দালাল হাটখোলা, কাউনিয়া সদরের মীরবাগ রেলস্টেশন, হলদিবাড়ী, তকিবল বাজার, স্টেশন বাজারসহ তিস্তার বিভিন্ন চর এলাকায়। সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ইয়াবার পাইকারি বিক্রেতা বা সেলসম্যানের ভূমিকায় রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। আবার রাজনীতি না করলেও খুচরা বিক্রেতারা বিক্রি করছেন অর্থের লোভে। প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানরা স্কুল বা ইন্টারমিডিয়েট থেকেই ইয়াবা খাওয়া শুরু হয় করছেন। এ ছাড়া পীরগঞ্জে ড্যান্ডি দিয়ে মাদক সেবন শুরু করছেন অনেকে। এরপর আস্তে আস্তে অন্য মাদকের দিকে ঝুঁকছে তরুণ-তরুণীরা। বিশেষ করে পীরগঞ্জের কলেজ শহীদ মিনারের পেছন, বিলের ধার, মেসে উঠতি তরুণদের মাদকের আড্ডা বেশি বসছে। এসব আসরে গাঁজা সাধারণত ‘শুকনা’, ‘সবজি’ নামে পরিচিত, ইয়াবা বা বাবা দু-তিন প্রকার রয়েছে। এর মধ্যে ২৫০ থেকে ৫০০ এবং ১০০০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে এই মাদক। আর ফেনসিডিলের দামও ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। যদিও তা ‘ডাইল’ নামে বেশি পরিচিত। আর ২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে গাঁজার পুঁটলি। অনেকে গ্রাম হিসেবে কিনছেন। এ এলাকার চিহ্নিত দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও বার বার ছাড়া পাচ্ছেন। আর পীরগঞ্জের মাদারগঞ্জ বন্দরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মাঠে সন্ধ্যা নামলেই বসে ‘বাবা’র আসর। জানা গেছে, প্রতিদিন হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল ও হাজার হাজার পিস ইয়াবা কেনাবেচা হয়। এখান থেকেই খুচরা বিক্রেতার হাত হয়ে মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে পড়ে জেলার পাড়ায়-মহল্লায়। আবার মাদকের টাকা পরিশোধ হচ্ছে বিভিন্ন মোবাইলে ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি ছিন্নমূল বা দরিদ্র পরিবারের শিশু ও স্বামীপরিত্যক্তা নারীদের দিয়ে মাদক বহন ও বিক্রি করানো হচ্ছে।

কয়েকটি ঘটনা : ‘ছিনতাই বলেন, চুরি-ডাকাতি, হাইজ্যাক বলেন, কিছুই বাদ নাই’— কথাগুলো বলছিলেন বছর তিরিশেক বয়সের এক যুবক। নেশা করছেন নয় বছর ধরে। চাকরি করতেন। নেশার কারণে সেটা গেছে। প্রতিদিন নেশার জন্য লাগত প্রায় ৩০০০ টাকা। ঘরের জিনিসপত্র চুরি করে বিক্রি করার পর শুরু করেন চুরি-ছিনতাই। ঘরে স্ত্রী, দুটি ছেলেমেয়ে। অবশেষে বাবা-মা-স্ত্রী সবাই মিলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভর্তি করিয়েছেন নগরীর এক নিরাময় কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে চিকিৎসা চলছে ৬০ বছরে এক বৃদ্ধের। পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক। বছরখানেক আগে অবসরে গেছেন। সেরা শিক্ষকের সম্মাননাও পেয়েছেন একবার। গোপনে গোপনে বহুদিন থেকে জড়িয়ে আছেন নেশায়। রাতে ঘরে ফেরেন না। স্ত্রী-সন্তানরা কেউ টুঁশব্দ করেন না। কারণ, সবাই তাকে ‘বাঘের মতো’ ভয় পান। জমিজিরাত সব শেষ করে ‘বিবেকের দংশনে’ স্বেচ্ছায় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন। শিক্ষকের মতোই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মাত্র ১৩ বছরের এক কিশোর ইয়াবার নেশায় জড়িয়ে বাড়িতে সৃষ্টি করেছে ঘোর অশান্তি। টাকা দেওয়া বন্ধ হওয়ায় জড়িয়েছে ছিনতাইয়ে। তাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছে তার পরিবার। এক যুবক ধ্বংস করেছেন ৮০ লাখ টাকার ব্যবসা। শহরে নিজের ক্লিনিক আছে এমন এক চিকিৎসক গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন এখানে। আছেন এক সরকারি কর্মচারী, যাকে তার সন্তানরা ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন এখানে। মাদকাসক্তির ভয়াবহ বিস্তারের ফলে রংপুর মহানগরে গড়ে উঠেছে ১০টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। প্রতি মাসে ২০০-৩০০ মাদকাসক্ত এসব কেন্দ্রে ভর্তি হন। ‘স্বপ্ন’ নামের মাদক নিরাময় কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের এখানে যারা আসেন, তার ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মাদকাসক্তদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ ছাত্র, তরুণ ব্যবসায়ী বা বেকার যুবক। শিক্ষক আসেন প্রায় ১০ শতাংশ। তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। চাকরিজীবী আসেন প্রায় ১৫ শতাংশ। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক দিলারা রহমান বলেন, তাদের কোনো অস্ত্রধারী লোকবল নেই। পুলিশের সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে অভিযান পরিচালনা বা গ্রেফতার করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া রয়েছে লোকবলের স্বল্পতা। সমস্যা হলো, মাদকসংক্রান্ত প্রচলিত আইনটি ১৯৯০ সালের। এ আইনের বেশ দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে গ্রেফতারকৃতরা সহজেই জামিন পেয়ে যান। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। এ সুযোগ নিয়ে রংপুরে মাদক ব্যবসায়ীরা দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুদের ব্যবহার করছেন। এজন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা দরকার। অধিদফতর থেকে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদকের ব্যাপারে প্রশাসন জিরো টলারেন্সে আছে। অভিযান চালিয়ে প্রতিদিন মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ছাড়া জনসচেতনতা বাড়াতে নগরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মাদকবিরোধী সমাবেশ করা হচ্ছে। এর ফলে মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীর সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।

সর্বশেষ খবর