বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

শ্রীপুরে নদ ও বন দখলের উৎসব, দেখার কেউ নেই

সাঈদুর রহমান রিমন ও শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ

শ্রীপুরে নদ ও বন দখলের উৎসব, দেখার কেউ নেই

ধাওর নদের একাংশ দখল করে নিয়েছে রেনাটা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

যেখানেই বনভূমি সেখানেই চলে ওষুধ কোম্পানি রেনাটা লিমিটেডের আগ্রাসী থাবা। সরকারি বনভূমির মূল্যবান বৃক্ষরাজি মুহূর্তেই ধ্বংস করে একরের পর একর জায়গা পরিণত করা হয় বিরানভূমিতে। সেখানে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের নামে চলে বিদেশি লতাপাতা সৃজনসংক্রান্ত নানা প্রকল্পের তত্পরতা। শুধু বনভূমি আর বনাঞ্চল দখল করেই ক্ষান্ত থাকেনি রেনাটা, তাদের দখলের আগ্রাসী থাবা থেকে গাজীপুরের খাল-বিল-নদী পর্যন্ত রক্ষা পাচ্ছে না। রেনাটার দখলবাজির থাবা পড়েছে জয়দেবপুর উপজেলার মির্জাপুরের ডগরী নয়াপাড়ার জনবসতিতেও। সেখানে নিরীহ আবদুল জলিল বয়াতিসহ অন্তত ১১ জন বাসিন্দার ভিটেমাটি পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের এসব জায়গাজমি রেনাটা গ্রুপের বাউন্ডারি-ওয়ালের ভিতরে আটকে ফেলা হলেও এর প্রকৃত মালিকরা আশ্রয়হীন অবস্থায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের জীবন চলছে সীমাহীন অনিশ্চয়তায়, পথে প্রান্তরে। প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তারা রেনাটার কব্জা থেকে নিজেদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি উদ্ধার করতে পারেননি। উপরন্তু যা কিছু সম্বল ছিল সেসবও হারিয়ে গেছে আইনি লড়াই চালাতে গিয়ে। রেনাটার দাপটের সামনে ভূমি মালিকদের আকুতি-মিনতি বিন্দুমাত্র পাত্তা পায়নি। গাজীপুরের শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের উত্তর পেলাইদ মৌজার ধাওর নদের দুখোলা সেতুর পশ্চিমে সরকারি বন বিভাগ ও নদের অংশ মিলে ১০০ বিঘা জমি দখলে নিয়েছে রেনাটা গ্রুপ। এরই মধ্যে উঁচু প্রাচীর নির্মাণের মাধ্যমে জায়গাটির তিন পাশ ঘিরে ফেলা হয়েছে। তবে উত্তরপাশের বাউন্ডারি নির্মাণ করতে গিয়ে বন বিভাগের বাধায় তা সম্পন্ন করতে পারেনি রেনাটা। আর এ জমি দখলে নিতে সরকারি বন বিভাগের নামে থাকা আরএস, সিএস রেকর্ডেও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ভূমি অফিসের রেকর্ড ভলিউম ঘষামাজা করে বন বিভাগের স্থলে রেনাটার নাম সংযুক্ত করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। তারা জানান, সাবেক এসএ দাগ নম্বর ১১২-এর অন্তর্ভুক্ত জায়গাজমির ব্যাপারে অনুসন্ধান চালালেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে। জমির দক্ষিণ পাশ ঘেষা নয়নপুর টু বরমী পাকা সড়ক। এ সড়কের দুখোলা ব্রিজের পাশেই রেনাটার দখল করা জমির অবস্থান। এ সড়কের দক্ষিণে থাকা লেকসদৃশ সরকারি খালের অনেক অংশজুড়েও রেনাটার জবরদখল পাকাপোক্ত হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেনাটা গ্রুপের দখল করা জমির মালিকানা ছিল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার শ্রী আচার্য চৌধুরীর। যিনি ভাওয়াল রাজার একটি পরগনা দেখাশোনা করতেন বলে জানায় এলাকাবাসী। পরে মুক্তাগাছার জমিদার শ্রী আচার্য চৌধুরী জমিগুলো বন বিভাগের অনুকূলে হাওলা করে দেশ ছেড়ে চলে যান। পরে শ্রীপুরের পেলাইদ, বরমী, নয়নপুর, নিমাইচালা, পোশাইদ, শিমুলতলা, তালতলী, উত্তর পেলাইদ গ্রামের কিছু দালাল বিভিন্ন সময়ে জাল কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে সেসব জায়গাজমির ভুয়া মালিক সেজে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে কেনাবেচা চালাতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় রেনাটা গ্রুপ অন্তত ১০০ বিঘা জমি স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে নামকাওয়াস্তে কাগজপত্র বানিয়ে নিজেদের দখলে নেয়। পরে দখল করা জমির পূর্ব সীমানা দিয়ে বয়ে যাওয়া ধাওর নদের বিভিন্ন অংশও রাতের আঁধারে ভরাট করে বাউন্ডারি-ওয়াল নির্মাণ করে। আর এ নদের গতিপথ পূর্ব পাড়ে থাকা সরকারি বনের জমি কেটে নালা বানিয়ে পানির প্রবাহ ঠিক রাখার অপকৌশলও চালায় রেনাটা। সেখানে মামুন ফকির নামে এক ব্যক্তি রেনাটার দখলবাজির সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মামুনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রশিদ। উভয়ের নিয়ন্ত্রণে ১০-১২ জন দুর্বৃত্ত সর্বদা রেনাটার জবরদখল করা জায়গাজমি দেখভাল করেন। সরেজমিনে দেখা যায়, বরমী-নয়নপুর সড়কের দুখোলা ব্রিজ তার স্বঅবস্থানে থাকলেও নদের অর্ধেক দখলে নিয়েছে রেনাটা গ্রুপ। নদের অংশ দখলে নিয়ে বাউন্ডারি-ওয়াল নির্মাণ করেছে তারা। ব্রিজের অর্ধেকাংশ রেনাটা গ্রুপের বাউন্ডারি-লাগোয়া; যা দেখলেই যে কেউ সহজেই বুঝে নেবেন নদও তাদের দখলে রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘ভাই! এসব ছিল খোলা সবুজ বনভূমি। আর এ বনভূমিতে কুদৃষ্টি পড়ে রেনাটার মতো রাঘব-বোয়ালদের। আর এদের কুদৃষ্টিতেই আজ বনভূমি বিলীনের পথে।’ রেনাটার দখলবাজির শিকার ধাওর নদে মাছ শিকার করতে যাওয়া লোকজন বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকায় বর্ষাকালে ধাওর নদে প্রচুর মাছ আসত; যা শিকার করে এলাকার অনেক পরিবার সারা বছর নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। আর এখন বড় বড় কারখানার কবলে পড়ে নদ বিলীনের সম্মুখীন। নদের গতিপথ বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা এখন আর আগের মতো মাছ ধরতে পারি না।’ এ ব্যাপারে বন বিভাগের শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পেলাইদ মৌজার বিশাল অংশ রয়েছে যা বনের জমি। আর জমি রেনাটা গ্রুপসহ কয়েকটি কারখানা নিজেদের দখলে নিতে বাউন্ডারি-ওয়াল নির্মাণ করতে গেলে আমরা বন বিভাগের পক্ষে বাধা দিই; যা এখনো অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে।’ 

সর্বশেষ খবর