রবিবার, ৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফের আতঙ্কে আরেক কূটনীতিক

৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের নির্দেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

ফের আতঙ্কে আরেক কূটনীতিক

কূটনীতিকদের গৃহকর্মী কেলেঙ্কারির ধারাবাহিকতায় যোগ হলো আরও একজনের নাম। সেই কূটনীতিক রয়েছেন গ্রেফতার আতঙ্কে। তারও গৃহকর্মী যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ডেপুটি কনসাল জেনারেল কাজী আনারকলি ইসলাম। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২৯ জুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাজী আনারকলিকে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের আদেশ দেয় ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বদলি করা হয় ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার বাংলাদেশ দূতাবাসে। সে হিসেবে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে ও মিশন থেকে বিদায় সংবর্ধনা নিয়ে প্রস্তুত আনারকলি। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাস-সৃষ্ট ভিসা বিড়ম্বনায় এখনো যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে পারেননি আতঙ্কে থাকা এ নারী কূটনীতিক। অবশ্য এই নারী কূটনীতিকের গৃহকর্মী পরিচয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ৪০ বছর বয়স্ক সাব্বির গতকাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেননি। জানা যায়, ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসেবে যোগ দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কাজী আনারকলি। তার বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার পিঁপড়াকাঠি। ওই এলাকারই অধিবাসী ও কাজী আনারকলির দূরসম্পর্কের আত্মীয় সাব্বির (৪০) নামের একজনকে গৃহকর্মী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান তিনি। কিন্তু সেই ডেপুটি কনসাল জেনারেল কাজী আনারকলির এই গৃহকর্মী যুক্তরাষ্ট্রে আসার কিছুদিন পরই লস অ্যাঞ্জেলেসে তার বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হন। গৃহকর্মী নিখোঁজের পর ওয়াশিংটন দূতাবাসে বিষয়টি জানানো হয়। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার শামীম আহমেদ বলেছেন, বিষয়টি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে। সূত্রমতে, নিউইয়র্কের ডেপুটি কনসাল জেনারেল পদ থেকে সম্প্রতি জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কাউন্সিলর হিসেবে বদলি হওয়া শাহেদুল ইসলাম ও জাতিসংঘ সদর দফতরের বাংলাদেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হামিদুর রশীদের ঘটনার পর কাজী আনারকলি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি দ্রুত অন্য কোনো দেশে বদলির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জোর তদবির চালান। ঢাকার মন্ত্রণালয় থেকেও যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি এড়াতে কাজী আনারকলিকে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বাংলাদেশ দূতাবাসে মিনিস্টার পদে বদলি করা হয়। সর্বশেষ ২৯ জুন তাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের আদেশ দেয় ঢাকা। ইন্দোনেশিয়ায় সাধারণত বাংলাদেশিরা ট্যুরিস্ট হিসেবে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পেয়ে থাকেন। কাজী আনারকলি ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট হোল্ডার হওয়ায় তার ভিসা আরও দ্রুত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডিপ্লোমেটিক অ্যাসাইনমেন্টে ইন্দোনেশিয়ার ভিসার জন্য আবেদন করা কাজী আনারকলি এবং যুক্তরাষ্ট্রে তার সঙ্গে থাকা মা ও সন্তানের ভিসার আবেদন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা করে ইন্দোনেশিয়া দূতাবাস। এ কারণে এখনো যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে পারেননি কাজী আনারকলি। ইন্দোনেশিয়ায় থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা কাজী আনারকলির ভিসা জটিলতায় সেখানে পৌঁছানোর বিলম্বের কথা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন। তবে শুক্রবার লস অ্যাঞ্জেলেস কনসুলেটে তাকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের এক কর্মকর্তা।

জানা যায়, কমপক্ষে সাত মাস আগে কাজী আনারকলির গৃহকর্মী তার বাসা ত্যাগ করে পালিয়ে যান। কিন্তু বিষয়টি নিউইয়র্কের সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কাজী আনারকলি। মিশনের অন্য কর্মকর্তারাও কোনো কথা বলতে রাজি হননি সব সরকারের আমলে পররাষ্ট্র ক্যাডারের প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত কাজী আনারকলির বিষয়ে। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে ছাত্রলীগ করা কাজী আনারকলি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। বিবাহিত আনারকলি পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকারের সময় ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একজন এডিসির সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সে সুবাদে বিএনপি সরকারের সময় পররাষ্ট্র দফতরে ক্ষমতাশালী কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন আনারকলি। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পালাবদলের পর তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে পুরনো যোগাযোগের সুবাদে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব লাভ করেন। ২০১৫ সালে তার যুক্তরাষ্ট্রে পোস্টিং হলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার স্বামীর পরিচয় নিয়ে কথা ওঠে। ঘটনাক্রমে ঠিক ওই সময়ই দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের ছেদ ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান সাবেক ছাত্রলীগ হিসেবে এখনো প্রভাবশালী থাকা কাজী আনারকলি। নিউইয়র্কের কমিউনিটি লিডাররা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নির্যাতিত গৃহকর্মীরা আবেদন করলে খুব সহজেই গ্রিনকার্ড পেয়ে যান। এ কারণেই গৃহকর্মীরা পালিয়ে গিয়ে মামলা করেন। আবার কূটনীতিকরাও বিভিন্ন সময় তাদের আত্মীয়স্বজন বা আর্থিক সুবিধার ভিত্তিতে অন্যদের যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ দিতে গৃহকর্মী পদটিকে ব্যবহার করেন। এর আগে এক পেশাদার কূটনীতিক নিউইয়র্কে দায়িত্ব পালনে যোগ দিতে গিয়ে দুজন গৃহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তাদের জ্যাকসন হাইটসে রেখে বদলি হয়ে ইতালি চলে যান। লস অ্যাঞ্জেলেসে পোস্টিং নিয়ে যাওয়া আরেক কূটনীতিক তার আপন ভাইকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে সেখানেই রেখে চলে যান নতুন দায়িত্বে। নিউইয়র্কে যাওয়া আরেক পেশাদার কূটনীতিক তার আপন ভাতিজাকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে নিউইয়র্কে রেখে নতুন দায়িত্বে যাওয়ার উদাহরণ দেখছেন এসব কমিউনিটি লিডাররা। তাদের মতে, এখন এসব গৃহকর্মী বিদেশে তাদের রেখে না এলেই তারা পালিয়ে যান। তারপর কূটনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এভাবে তারা যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড পেয়ে যান। ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাড়ে ও বাংলাদেশের কূটনীতিক মনিরুল ইসলামের নামে তাদের গৃহকর্মীরা মামলা করে ইতিমধ্যে গ্রিনকার্ড পেয়েছেন।

এদিকে লস অ্যাঞ্জেলেস মিশনের কেউ কাজী আনারকলির গৃহকর্মী নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা না বলায় তৈরি হয়েছে নানা ধরনের ধারণা। কেউ কেউ বলছেন, তাকে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে বা আত্মীয়তার কারণে নিউইয়র্কে নেওয়া হয়েছিল কি না তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

কারণ একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ নারী কূটনীতিকের পক্ষে ৪০ বছর বয়স্ক পুরুষ গৃহকর্মী খানিকটা অস্বাভাবিক। কমিউনিটি লিডার ও মূকাভিনেতা কাজী মশহুরুল হুদা বলেছেন, কনসুলেট অফিস কথা না বলায় কিছুই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে একটা কিছু ঘটেছে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর