মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

মামলার সাজা শঙ্কা বিএনপিতে

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুই মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে, তারেক-খোকাসহ কয়েক নেতাকে সাজা, ফখরুলসহ সিনিয়র নেতাদেরও চলছে বিচার

নিজস্ব প্রতিবেদক

জিয়া চ্যারিটেবল ও অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গত বৃহস্পতিবার আদালতে হাজিরা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। আগামী বৃহস্পতিবার আবারও হাজিরার দিন ধার্য রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে। তার বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলা। এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ও অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষেই যুক্তিতর্ক। এরপর রায়। নাইকো, গ্যাটকোসহ আরও কয়েকটি মামলার বিচার কার্যক্রমও চলছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘সাজা’ দিতেই তড়িঘড়ি করে সরকার দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে চাচ্ছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য করাই উদ্দেশ্য। বিএনপি-প্রধানকে রাজনীতি থেকেও দূরে সরানোর অপচেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে এক মামলায় সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলার খড়্গ ঝুলছে। ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোকেও ছয় বছরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। দুর্নীতির এক মামলায় তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানকে কয়েক দিন আগে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। শাশুড়ি সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুর বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। কার্যত, মামলার জাঁতাকলে এখন জিয়া পরিবারের সদস্যরা। জিয়া পরিবার ও বিএনপিকে নির্মূলই সরকারের টার্গেট। বেগম জিয়ার একাধিক আইনজীবী শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যেভাবে এ দুই মামলায় প্রভাবিত করে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তাতে নেতিবাচক ফল এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে ন্যায়বিচার পেলে বেগম জিয়া নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। ঘন ঘন তারিখ আর সরকারের মনোভাবে বিএনপি-প্রধানকে ‘সাজা’ দেওয়া হতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। এ নিয়ে আইনজীবীর পাশাপাশি দলের সর্বস্তরের নেতাও শঙ্কিত। এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলা চলার গতিপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে সরকারের কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে। আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের যেনতেনভাবে সরকার নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণায় মরিয়া। তবে আমরা হাল ছাড়ছি না।’

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে দেওয়া বক্তব্যে মানহানির মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিচার শুরু হয়েছে। আদালত আগামী ৩ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক করেছে। গত রবিবার ঢাকার মহানগর হাকিম নূরনবী অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের এই দিন ঠিক করেন। ফখরুলের বিরুদ্ধে সর্বমোট ৮৬টি মামলা। এর মধ্যে ৪২টি অভিযোগ গঠন ও অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। অন্য ৪৩টি মামলা তদন্তাধীন।

এরই মধ্যে দুর্নীতির এক মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার ১৩ বছরের সাজা হয়েছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরকেও ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। গতকাল দুর্নীতির মামলা বাতিল চেয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের রিভিউ আবেদন খারিজ করেছে আপিল বিভাগ। এর ফলে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে বিএনপির এ দুই নেতার বিরুদ্ধে মামলা চলতে আইনগত কোনো বাধা নেই বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

জানা যায়, জিয়া চ্যারিটেবল ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় নিম্ন আদালতে সাজা হলে আইনি লড়াইয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বেগম খালেদা জিয়া। এতে নির্দোষ রায় পাওয়ার আশা করছেন বিএনপি-প্রধানের আইনজীবীরা। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে করণীয় নিয়েও ভাবছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। সাজা হলে নিয়ম অনুযায়ী কারাগারে গিয়ে জামিন চাইতে হবে। এদিকে এক মামলায় সাজা হওয়ায় তারেক রহমানকে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হলে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। তারপর জামিন চাইতে হবে। দলীয় কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৫ লাখেরও ওপরে। এ ছাড়া রাজনৈতিকভাবে গুম, খুন ও অপহরণ করা হয়েছে ৪৩৬ জনকে। এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ গুম করা হয়েছে ২৭ জনকে। এর মধ্যে ১২ জনই ঢাকা মহানগরী ছাত্রদলের নেতা। সারা দেশে ১০ হাজারের ওপর নেতা-কর্মী কারাগারে রয়েছেন। সর্বশেষ জেলে যান বিএনপি নেতা বরকত উল্লা বুলু ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক। জানা যায়, মামলা হওয়া নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৬টি মামলার সবকটিতেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলার মধ্যে ৯টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তরিকুল ইসলামের ৮টি মামলার ৫টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এম কে আনোয়ারের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলার মধ্যে ১৮টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ২৬টি মামলার মধ্যে ১৪টিতেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলার মধ্যে ২৮টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। গয়েশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলার মধ্যে ১৮টিতেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৯টি মামলার মধ্যে ৩টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, বিএনপি নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ১৩৬টি মামলা রয়েছে। প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরব ও সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু।

দলীয় সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে— তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দলের নেতা-কর্মীরা। দুর্নীতির এক মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাজা হয়ে যাওয়ায় আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়াও অনিশ্চিত হয়ে গেছে। বিএনপির তরুণ নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে হতাশাবোধ দেখা গেছে। বিএনপি চেয়ারপারসনকে ‘সাজা’ দেওয়া হলে দল কীভাবে চলবে তা নিয়েও নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রশ্নের শেষ নেই। দলের মধ্যে সুবিধাভোগী একটি অংশ নতুন কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় কিনা— তা নিয়েও শঙ্কায় তৃণমূল বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তবে মাঠ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মামলার ভবিষ্যৎ যাই হোক, বিএনপিকে কেউ আর ভাঙতে পারবে না। কারণ ওয়ান-ইলেভেনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নিয়ে বেগম জিয়া দলকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। বর্তমান সরকারের দুঃশাসনেও বিএনপি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। জুলুম-নির্যাতন সয়ে বিএনপি এখন স্বরূপে দাঁড়িয়ে। দলের দু-চার জন চলে গেলেও কোনো সমস্যা হবে না।

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতেই একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে। যেহেতু তারা রাজনৈতিকভাবে বিএনপির সঙ্গে পেরে উঠছে না তাই ওই পথ বেছে নিয়েছে। মামলাকে অস্ত্র হিসেবে নিয়েছে। গ্রামের মোড়লরা প্রতিপক্ষকে যেভাবে মিথ্যা মামলা দেয়, বিএনপির বিরুদ্ধে সরকার তেমনই করছে। আমরা যাতে রাজনীতি না করতে পারি, তাই এ অপকৌশল। তারা চেষ্টা করছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। যদি কোনো রাজনৈতিক দল দেউলিয়া হয়ে যায়, তখনই তারা এ ধরনের কাজ করে।’

সর্বশেষ খবর