মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য

রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই দেশের ব্যাংকিং খাতে সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। যা এ খাতকে দুরবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য। তিনি আরও বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের ভিতরে সুশাসন না থাকা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথভাবে দেখভাল না করা ও অর্থ বিভাগের তদারকির ঘাটতি রয়েছে— এটা ঠিক। কিন্তু এগুলোর বাইরে সবচেয়ে বড় কথা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক সিগন্যাল না থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতারও প্রয়োগ করা যায় না। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে জাতীয় বাজেট ২০১৭-১৮ অনুমোদন পরবর্তী পর্যবেক্ষণ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন দেবপ্রিয়। অনুষ্ঠানে তিনিই অনুমোদিত বাজেটের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, পরিচালক (সংলাপ) আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ এবং গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ। দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এটা অযৌক্তিক এবং অন্যায়। এই টাকা দেওয়া উচিত নয়। সিন্ধুর মধ্যে বিন্দুর মতো তা তলিয়ে যাবে। তিনি বলেন, নতুন ব্যাংকের পাশাপাশি প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকও এখন সমস্যায় পড়েছে। ব্যাংকের অভ্যন্তরে সুশাসনের অভাব রয়েছে প্রকট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নজরদারি করার কথা ছিল, তা হয়নি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ আবর্জনা পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। এখনই সংস্কার-প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে দেবপ্রিয় বলেন, নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন-২০১২ ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিং’ করেছে। নতুন ভ্যাটের প্লেন উড়তে পারেনি। মুখ থুবড়ে পড়েছে। নির্বাচনের পরে যাতে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে না হয়। সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই অনলাইন-ব্যবস্থাসহ অন্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। ক্র্যাশ ল্যান্ড করা প্লেন আবার উড়াতে হবে। সরকারের জন্য এটাই মূল চেষ্টা হওয়া উচিত বলে মনে করে সিপিডি। তিনি বলেন, সিপিডি নতুন আইনের পক্ষে। তবে যদি ১২ শতাংশ একক ভ্যাট হার নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হতো। তা হলে সেটা হতো জনকল্যাণের ভ্যাট আইন। এমনকি সেটা করা হলে নতুন আইনের এই পরিণতি হতো না। তিনটি কারণে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে মনে করে সিপিডি। এগুলো হলো প্রস্তুতির অসম্পূর্ণতা, রাজনৈতিক সহমতের অভাব এবং সামাজিক তাৎপর্যের প্রভাব। সিপিডি মনে করে একক ভ্যাট হার না থাকায় এত দিন যারা সুবিধা পেয়েছেন, নতুন আইনে তারা অসুবিধায় পড়তেন। আবার রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তি এত দিন অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিষয়টি দুই দিক থেকে দেখতে হবে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজস্ব ঘাটতি বাড়বে চলতি অর্থবছরে (২০১৭-১৮) শেষে। সিপিডি মনে করে, রাজস্ব আদায়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে বছর শেষে। পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, বাজেটের ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে বেশি ঋণ নেওয়ায় সরকারের দায় বাড়ছে। কেননা এতে বেশি পরিমাণে সুদ গুনতে হচ্ছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এটি মধ্যমেয়াদে টেকসই হবে না। এর পরিবর্তে ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নেওয়া উত্তম হবে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটি আরও মনে করে সঞ্চয়পত্র সামাজিক সুরক্ষার বিষয় নয়। অন্যভাবে খরচ করেও সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, একদিকে টাকা বিদেশে চলে যাবে, অন্যদিকে সৎ করদাতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে। এটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। টাকা পাচারকারীর নাম-পরিচয় জানার পরও যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয় আবার সৎ করদাতাদের ওপর করের জন্য যদি চাপ সৃষ্টি করা হয় এতে ন্যায়বিচার হয় না। সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এমনিতেই নির্বাচনের বছরে টাকা পাচার বৃদ্ধি পায়। এসব বিষয়ে সরকারের উচিত আরও সচেতনতার সঙ্গে কাজ করা। সংস্থাটির বিশেষ ফেলো  ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে হবে কর্মসংস্থানমুখী। শুধু জিডিপি বাড়বে অথচ সেই হারে কর্মসংস্থান বাড়বে না। এমন কর্মসংস্থানহীন জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য কতটা কল্যাণ বয়ে আনছে সেটা ভাবার সময় এসেছে। এ জন্য অর্থনীতি বহুমুখীকরণ করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি নিতে হবে। উৎপাদনশীলতা-নির্ভর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। যার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এ ছাড়া বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পাশাপাশি বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর