মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্ম চিন্তা

হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ কাজী নজরুল ইসলাম

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ কাজী নজরুল ইসলাম

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশিত হলো যখন, তখনো আমার জন্ম হয়নি। সাল ১৯২৮। ওই বছরই বইটির দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীশ্রীচরণাবিন্দেষু স্মরণে। বইটি বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে হারাগাছ তরুণ সমিতি কবিকে সংবর্ধনা দেয়। বইটির প্রথম সংবর্ধনা। কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ পরে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করেন মাওলা ব্রাদার্সের সহায়তায়। বইটির মাঝামাঝি একটি কবিতার নাম : হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ। এই নিয়ে আজকের কথাবার্তা।

রায়ট নয়, যুদ্ধ। নজরুল লিখছেন :

মাভৈঃ! মাভৈঃ! এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ,

সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান-গোরস্থান!

এরপর নজরুল সেই যুদ্ধে টেনে নিয়ে এসেছেন মুসলিম বীর খালেদকে, সেই সঙ্গে হিন্দু বীর অর্জুনকে। এ তো রীতিমতো যুদ্ধ, ছিঁচকে রায়ট নয়, সেদিন যা কলুষিত করেছিল কলকাতার পথঘাট, নোয়াখালী, ঢাকা। কোথায় নয়? সাত বছরের বালক দেখেছে কীভাবে পার্ক সার্কাসে একজন ট্রাম ডিপোর হিন্দু দারোয়ানকে চোখের নিমেষে ছোরা দিয়ে ধরাশায়ী করল গুণ্ডা। কীভাবে কলকাতা মডার্ন স্কুলের হেডমাস্টার মহবুব আলিকে স্টেনগান দিয়ে শিখরা হত্যা করেছিল। আমরা ছাত্ররা সেই লাশ নিয়ে সারা দিন কবরস্থানে। আমার আব্বা আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। কোথায় হারিয়ে গেল আমার ছোট্ট ছেলেটি? এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। লাখ লাখ লোক এলাম ঢাকায়, ওরা গেলেন পশ্চিম দিকে। দাঙ্গার কথা ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। সে দাঙ্গা নজরুল দেখেননি। তবু লিখেছেন :

মরিছে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ,

বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ-মরণে নাহি লাজ।

জেগেছে শক্তি তাই হানাহানি

অস্ত্রে অস্ত্রে নব জানাজানি

আজি পরীক্ষা-কাহার দস্ত হয়েছে কত দারাজ।

কে মরিবে কাল সম্মুখ-রণে, মরিতে কা’রা নারাজ।

কে যে কাকে মারছে বোঝা যাচ্ছে না। এ অন্ধকার দূর হয়নি। শত্রু ভেবে যাকে মারছে, সে যে আপনজন। লোকসংগীতে যেমনটি পেয়ে থাকি : ‘ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে সেজন কি তোর পর/ও তুই ভ্রমর হয়া হানলি কাঁটা সেই না ফুলের পর, ও রে বন্ধু, সে জন কি তোর পর।’

নজরুলের বর্তমান কবিতাটি কয়েকবার পড়লাম, যা প্রথমে বেরিয়েছিল ‘ফণিমনসা’ কাব্যগ্রন্থে। এরপর গেল কত জুনাগড়, কত হায়দরাবাদ। কত মানুষের কান্না, তার ইতিহাস কোনো দিন মুছে যাবে না, পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। কাশ্মীরের লাখ লাখ মানুষের আহুতি কখনো বিফলে যাবে না, হাজার বছর পরেও সে অন্যায় মুছে ফেলা যাবে না। মুসলমানদের শত্রু সালমান রুশদি যখন বই লেখেন কাশ্মীর নিয়ে, তখন সে বই ভারতে নিষিদ্ধ হয়ে যায়, অরুন্ধতী রায় নিষিদ্ধ হয়ে যান। কারণ যুদ্ধ থামেনি। যুদ্ধের কারণ বেড়েছে। যেমনটি নজরুল লিখছেন :

উদিবে অরুণ ঘুচিবে ধন্দ

ফুটিবে দৃষ্টি টুটিবে বন্ধ

হেরিবে মেরেছে আপনার ভয়ে বদ্ধ করিয়া দ্বার!

ভারত ভাগ্য করেছে আহত ত্রিশাল ও তরবার।

পিতা আব্বাসউদ্দীন গেয়েছেন মৃণালকান্তি ঘোষের সঙ্গে এই গান, যা সেদিন স্থান পেয়েছিল লাখো মনের বৃন্তে :

‘ও ভাই হিন্দু মুসলমান,

হিংসায় গড়া তলোয়ারগুলি ভেঙে কর খান খান।

তোমরা যে ভাই বাংলার আশা

দু’জনারে দোঁহে দাও ভালবাসা

অবিশ্বাসের প্রাচীর গড়িয়া কর নাকো অপমান।’

আজও যুদ্ধ থেমেছে কি? দুটি দেশ তাদের আণবিক অস্ত্রের বোতামে হাত রেখে বসে নয় কি? তাহলে কী হবে নজরুলের এই কবিতায় :

যে-লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দিরচূড়া,

সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দূর্গ গুঁড়া!

প্রভাতে হবে না ভায়ে-ভায়ে রণ,

চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন।

করুক কলহ-জেগেছে তো তবু-বিজয়-কেতন উড়া!

ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া!

যুদ্ধের দামামা বাজেনি, বাজছে অন্য কোথাও, সেটা শুনতে পারছি। পাকিস্তান কিছুই মেনে নেয়নি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যে কটি হয়েছে, সেগুলো হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ, আর কিছু নয়। ধ্বংস চায় ওরা। মেনে নেয়নি চীন, রাশিয়া এসে যোগ দিয়েছে। প্রয়োজন ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, সিকিম, ভুটান সব অঞ্চলের মানুষের সার্বিক একাত্মতা। বাংলাদেশের মানুষ কারও অধীনতা মানবে না। কারও চালাকি খাটবে না। কারও অধীন নই, কোনো দিনও না। চালাকি ভুলে যান। ধ্বংসের দাবানলের মুখোমুখি। সংকেত নজরুলের কবিতায়।

নজরুল হয়তো বলতে চেয়েছেন যে হিন্দু-মুসলমানের এই সংঘাত শেষ পর্যন্ত শত্রুদুর্গ গুঁড়ো করতেই সহায়তা করবে। আসলে তা করেনি। ব্রিটিশরা চক্রান্ত করে দেশটিকে আরও তছনছ করে দিয়েছেন। নেতারা তাকিয়ে ছিলেন শুধু। কোনো সহায়তাই করতে পারেননি। এই কারণে যে দাঙ্গা দিনে দিনে বিস্তৃত থেকে আরও বিস্তৃত হয়েছে। ভারতে এই দাঙ্গা ক্ষণে ক্ষণে মহামারী রূপ নেয়। যারা অসাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত তারা চোখ বন্ধ করে থাকেন। ভাবেন যে, এ সংকট কেটে যাবে। আমিও বেশির ভাগ সময়ই মিলনের গান দিয়ে আমার কর্তব্য সমাধা করি। কিন্তু ব্যাপারটি এতই সহজ? যারা উন্নত মনের অধিকারী তারা কী লিখেছেন, তার একটি সংকলন প্রকাশিত হতে পারে। তা এখনো হয়নি। অরবিন্দ, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব চিরদিন মিলনের অগ্রদূত। তাদের কথা আমরা শুনিনি। না শুনেই হয়েছে বিপদ। নজরুলের এই কবিতায় নেই কোনো দিগ্দর্শন। অথচ এটি ভারতের ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। তা হলো সবাইকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধর। কেউ তোমার শত্রু নয়। কথাটি প্রায়ই ভুলে যাই।

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর