বুধবার, ১২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ডিসেম্বর থেকেই লড়াই

যাত্রা শুরু হবে রংপুর ও গাজীপুর সিটি দিয়ে, আগামী বছর শুরুতে বাকি চার সিটির নির্বাচন প্রার্থী চূড়ান্ত করছে দুই দল, এতেই বোঝা যাবে আগামী জাতীয় সংসদের লড়াই

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

ডিসেম্বর থেকেই লড়াই

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধান দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ছয় সিটি করপোরেশনে। এর মধ্যে ডিসেম্বরেই যাত্রা শুরু হতে পারে দুই সিটি করপোরেশন গাজীপুর ও রংপুরের ভোট। বাকিগুলো, অর্থাৎ সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালে ভোট হতে পারে নতুন বছরের শুরুতেই। এপ্রিলের মধ্যেই ছয় সিটির ভোট সম্পন্ন করার কথা ভাবছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথমবারের মতো এই ছয় সিটিতে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে।

২০১৩ সালের ১৫ জুন একযোগে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছরের ৬ জুলাই হয় গাজীপুর সিটির নির্বাচন। এর আগে ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটিতে নির্বাচন হয়।

জানা যায়, এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট সিটি এলাকায় শুরু হয়েছে সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ। মেয়র পদে দুই দলই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করছে। বিগত মেয়াদে ছয় সিটির মধ্যে পাঁচটিতেই পরাজিত হয় ক্ষমতাসীন দল। সেগুলোতে জয়ী হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা দল বিএনপি। এবার আদাজল খেয়ে মাঠে নামছে দুই দলই। বিএনপি জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করলেও সিটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া আওয়ামী লীগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। সুষ্ঠু ভোট হলে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিগত সিটি নির্বাচনে সবচেয়ে ক্লিন ইমেজ ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের প্রার্থী করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারবিরোধী অপপ্রচারের কাছে আমরা পরাজিত হয়েছি। এবার সে ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য প্রচার-প্রচারণা এবং অপপ্রচারের জবাব দিতে সব ধরনের কৌশল হাতে নিচ্ছি। আমরা কেন্দ্রীয় নেতারাও সিটি এলাকাগুলোতে যাব। নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং উন্নয়ন প্রচার করাই আমাদের এখনকার অন্যতম কাজ।’ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোটেক রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ভোটের এখনো কয়েক মাস বাকি। গত নির্বাচনে মেয়র পদে যারা জয়ী হয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই তারা আগামী নির্বাচনেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারেন। অবশ্য দলীয়ভাবে এখনো প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। তফসিল ঘোষণা হোক। পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকেই নির্বাচনের বিষয় নিয়ে ভাববে বিএনপি।’

আওয়ামী লীগ : সিটি নির্বাচন ঘিরে অতীতের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য এখন থেকেই প্রার্থী বাছাই ও প্রচার-প্রচারণার কৌশল নির্ধারণ করছে ক্ষমতাসীন দলটি। ইতিমধ্যে রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে গ্রিন সিগনাল দিয়ে মাঠ গোছাতে বলা হয়েছে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় রংপুর সিটিতে বর্তমান মেয়র প্রবীণ নেতা শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকেই বেছে নেওয়া হতে পারে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জোর আলোচনায় সাবেক তিনবারের পৌর মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমতউল্লাহ এবং সাবেক ছাত্রনেতা গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। আগামী ডিসেম্বরে রংপুর ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু হবে দুই দলের ভোটযুদ্ধ। জানা যায়, শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটন ও সিলেটে বদরউদ্দীন আহমদ কামরানকে গ্রিন সিগনাল দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে রংপুর সিটি করপোরেশন বর্তমান মেয়র শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে। দলের সিগনাল পাওয়ার পর সিলেটে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। আজ বুধবার থেকে উঠান-বৈঠক ও গণসংযোগ শুরু করবেন লিটন। তাদের গণসংযোগ ও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় থাকবে বিএনপি আমলের সঙ্গে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের তুলনা, বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন ও নির্যাতনের ফিরিস্তি। আগামীতে আওয়ামী লীগ কী কী করতে চায় সেগুলোও তুলে ধরবেন তারা। দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, একাদশ নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনগুলোকে বিশেষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গণসংযোগ ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে নামছেন। কর্মিসভা, প্রতিনিধি সভা ও উঠান-বৈঠকের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় বিগত দিনের মতো যেন সরকারবিরোধী প্রচারণায় যেন বিএনপি সুবিধা করতে না পারে সে জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ এখন থেকেই নেওয়া হচ্ছে। এদিকে দলের গ্রিন সিগনাল পাওয়া দুই প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় নামছেন। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান গতকালও নগরীর কয়েকটি জায়গায় কর্মিসভা ও গণসংযোগ করেন। এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে আমি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। গত আট বছরে সরকারের উন্নয়নের ফলে দলের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নেতা-কর্মীরাও ঐক্যবদ্ধ। উন্নয়নের জন্য নগরবাসী আমাকেই বেছে নেবেন এটাই প্রত্যাশা।’ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, সিটি নির্বাচন সামনে রেখে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ ভোটার যারা নগরের উন্নয়ন চান, তারাও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তিনবারের সাবেক পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট আজমতউল্লাহ বলেন, ‘দলের সমর্থন নিয়ে তিনবার টঙ্গী পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলাম। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল আমাকে প্রার্থী করেছিল। কিন্তু একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে জয়লাভ করতে পারিনি। অতীতের মতো এখনো তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আছি। আমি শতভাগ আশাবাদী, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’ আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী সাবেক ছাত্রনেতা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি সিটির নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে আছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌকার জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করছি।’ রংপুর সিটি মেয়র শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু বলেন, ‘আমি অশাবাদী, দল আমাকেই মনোনয়ন দেবে। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে জনগণের ভোটে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নৌকা উপহার দেব।’

বিএনপি : ডিসেম্বর থেকে নতুন বছরে অনুষ্ঠেয় ছয় সিটি নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ সিটিগুলোতে জয়ী হয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি বার্তা দিতে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। গাজীপুরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হিসেবে বর্তমান মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান অনেকটাই নিশ্চিত। বিগত নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তিনবার বরখাস্ত হন। বিভিন্ন মামলায় একাধিকবার জেলও খাটেন। ২০-দলীয় জোটের পক্ষ থেকে তাকেই একক প্রার্থী করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। রাজশাহীতে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে বর্তমান মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল অনেকটাই নিশ্চিত। তিনি এরই মধ্যে মাঠের প্রচারণার পাশাপাশি ব্যস্ত ঘর গোছাতে। অবশ্য নগর বিএনপির সভাপতি হওয়ার পর থেকে দলের একটি বড় অংশের বিরোধিতার মুখেও পড়েন তিনি। সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মিনু ও বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলনের সঙ্গে তার শীতল সম্পর্ক। ফলে বুলবুলকে এখন দলের ভেতরে-বাইরে লড়াই করতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল জানান, নির্বাচিত হওয়ার পরও তাকে যে কাজ করতে দেওয়া হয়নি, সেটি নগরীর মানুষ জানেন। এ ছাড়া দলের ভেতরে আগে তার বিরুদ্ধে কিছু নেতা ছিলেন। কিন্তু এখন বিএনপির সব নেতা-কর্মী ঐক্যবব্ধ। আগামী নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী ঘোষণা হওয়ার পর মাঠে তা দেখা যাবে। রংপুরে এবার নতুন প্রার্থী হবেন, না বিগত নির্বাচনে যিনি অংশ নিয়েছেন তিনিই হবেন, তা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। গত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপির বর্তমান মহানগর সহ-সভাপতি কাউছার জামান বাবলা। এবারও তারই নির্বাচন করার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে তিনি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। পাশাপাশি মহানগর সভাপতি মোজাফফর হোসেনও প্রতীক পেতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তিনি এখনো মাঠে নামেননি। সিলেটের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর দলীয় প্রতীক পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মামলায় সাজা বা অন্য কোনো কারণে তিনি নির্বাচন না করতে পারলে সে ক্ষেত্রে সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম কিংবা যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হাসান কয়েস লোদী নির্বাচন করতে পারেন। তবে এই তিন নেতা বলছেন, তারা দলীয় প্রতীক চাইবেন। খুলনায় বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী মহানগর সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি। তিনিই দলের একক প্রার্থী হতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। বরিশালেও বর্তমান মেয়র আহসান হাবিব কামালই আগামী সিটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে পারেন। সেভাবে তার মাঠে প্রচারণা না থাকলেও তিনি বেশ আগ্রহী। এ ছাড়া দলের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়েদুল হক চান, মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন সিকদার ও সহ-সভাপতি হাজি কে এম শহীদুল্লাহও মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর