বুধবার, ১২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
যত মত তত ভাবনা

ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচের গাণিতিক বিপর্যয়!

গোলাম মাওলা রনি

ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচের গাণিতিক বিপর্যয়!

আবহমান বাংলার পুতুলনাচের কলাকৌশল ও ব্যাপক বিনোদন রীতিমতো কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। পুতুলের হাতে, পায়ে, গলায়, কোমরে এবং বুকে নিখুঁতভাবে সুতা বেঁধে মঞ্চের পেছন থেকে নান্দনিকভাবে নাচানোর অনুপম কৌশল ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ সবাই উপভোগ করতেন। পুতুলের নাচের সঙ্গে সঙ্গে বাহারি সংলাপ, চিত্রনাট্য, বাদ্যগীত এবং আলোকসজ্জাও ছিল অত্যন্ত মানানসই। পুতুলগুলোর কাহিনী শুনে এবং তাদের নৃত্যগীত দেখার পর আবেগ-উচ্ছ্বাসে দর্শকরা হাসি-কান্নায় একাকার হয়ে ধন্য ধন্য রব তুলতেন। নৃত্যগীতের পালা শেষ হওয়ার পর উৎসাহী দর্শক-শ্রোতা পুতুলনাচের কারিগর, আয়োজক ও কলাকুশলীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে মঞ্চের পেছনে ছুটে যেতেন। আমাদের দেশবাংলার সমাজ-সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিচার-শালিস প্রভৃতি নানান কাজে পুতুলনাচের সূক্ষ্ম কলাকৌশলগুলো অনুসরণ করে অনেকেই সফল হতেন। বাংলার পুতুলনাচের সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। প্রযুক্তির বাড়াবাড়ি, বিত্তবিলাসের কারণে সৃষ্ট অলসতা এবং অনুর্বর মস্তিষ্কের কারণে পুতুলনাচ এখন আর জমে না। এখনকার পুতুলনাচের কারিগররা এমন সব উদ্ভট সংলাপ এবং চিত্রনাট্য তৈরি করেন যা শিশুদেরও আকৃষ্ট করতে পারে না। মানুষের বিদ্যা ও বুদ্ধিতে যেন ডিজিটাল মোড়ক লেগেছে। সৃজনশীলতার পরিবর্তে গাঁজাখুরি, বিনোদনের পরিবর্তে সুরসুরি প্রদান এবং জোরজবরদস্তির সংস্কৃতি আমাদের নিত্যকার জীবনযাত্রাকে দিনকে দিন জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। প্রযুক্তির বাড়াবাড়ির কারণে এখন কোনো পুতুলের সর্বাঙ্গে নিখুঁতভাবে সুতা পরানো হয় না। অধিকন্তু কোনো কারিগর এখন আর মেধা খাটিয়ে নিজ হাতে পুতুলগুলো নাচান না। তারা একটি রোবট-জাতীয় পুতুলের হাতে নাচের পুতুলগুলোর পরিচালনার সুতা ধরিয়ে দিয়ে নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন এবং রিমোটের সাহায্যে রোবট পাপট বা পুতুলকে দিয়ে পুতুলনাচের কর্মাদি পরিচালনা করেন। ফলে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচের সংস্কৃতিতে রীতিমতো গাণিতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

একটি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের পতনের ঝঙ্কার আমাদের দৈনন্দিন ব্যবসা-বাণিজ্য, লুটপাট, রাজনীতি, কূটনীতি, প্রেম-পিরিতি এমনকি নির্মম ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডেও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। সর্বত্রই নির্বুদ্ধিতা, ভাঁড়ামি ও বাহুল্য বাসা বেঁধেছে। এখনকার চুরিবিদ্যাও কেমন যেন স্থবির লোক হাসানো কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। ডাকাতিবিদ্যাও ইদানীংকালে গোপনীয় কোনো বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে না। চোর-ডাকাতরা নির্ভীক চিত্তে অপকর্ম করে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে ওসব কুকর্মে যে সাসপেন্স, ঘৃণা, ভয়ভীতি, শাস্তি ইত্যাদি অতীতকালে ছিল তা এখন জাদুঘরের বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে চলেছে। খুন, ধর্ষণ, পরকীয়া প্রভৃতি অসামাজিক ও নির্মম ঘটনাও দিনকে দিন খোলামেলা এবং দিবালোকের কর্মে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ইতিপূর্বে মানুষ কুকর্ম করতে শতবার চিন্তা-ভাবনা করত এবং অত্যন্ত গোপনীয়তা ও সতর্কতার সঙ্গে অভীষ্টের দিকে পা বাড়াত। কালের বিবর্তনে কুকর্মকারীরা তাদের গোপনীয়তা, সতর্কতা, পরিকল্পনাসমূহ বিসর্জন দিয়ে তড়িঘড়ি অপরাধ সংঘটন করতে গিয়ে সবকিছুকে লেজেগোবরে বানিয়ে পুরো সমাজকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

আমাদের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচ ছিল মেধা, মননশীলতা এবং কঠোর পরিশ্রম ও অনুশীলনের চূড়ান্ত বাস্তব রূপ। যখন পুতুলনাচের কারিগররা দর্শকদের জন্য পরিশ্রম, সততা ও আন্তরিকতার পরাকাষ্ঠা দেখাতেন, তখন সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র একই রকম মেধা, মননশীলতা ও কর্মকুশলতার নীতি অনুসৃত হতো। সত্তর দশকে একজন গ্রাম্য মাতব্বরের বিচার-শালিস, আলেম-ওলামার ফতোয়া এবং নৈতিক চরিত্র অথবা মহাজনী ব্যবসায়ীদের নীতি-আদর্শের যে রূপ পরিলক্ষিত হতো তা ইদানীংকালে কল্পনাও করা যায় না। রাজনীতিবিদদের বিশাল হৃদয়, জনমানুষের জন্য দরদ এবং জনকল্যাণের জন্য জীবন-যৌবন উৎসর্গ করার ইতিহাস শুনে এখনকার রাজনীতিবিদরা কী ভাবেন তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের পদ-পদবি এবং পোশাকের মর্যাদা, নিজেদের জীবন, সম্পত্তি পারিবারিক স্বার্থের ওপর স্থান দিতেন। সরকারি তদন্ত, বিচার-আচার, দান-অনুদান এবং কাজকর্ম নিয়ে মানুষের ছিল অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। কালের বিবর্তনে ওসব বিষয় ইদানীংকালে কতটা হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, তা আমাদের সমাজ-সংসারে নির্লিপ্তভাবে দেখলেই বোঝা যায়। ইদানীংকালের গুম, হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, চুরি, চামারি, ডাকাতি-রাহাজানি ইত্যাদি সবকিছুতেই এক ধরনের ভৌতিক ফ্যান্টাসি যুক্ত হয়ে গেছে। হাল আমলের শিশুতোষ পুতুলনাচ টম অ্যান্ড জেরি কিট্স অথবা পুতুলনাচের চলচ্চিত্র দি অ্যাডভেনজার অব টিন টিন বা কুংফু পান্ডার চিত্রনাট্যের মতো করে এমন সব অদ্ভুত ঘটনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হামেশা ঘটে যাচ্ছে যা নিয়ে প্রশ্ন করাটা এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা বলে বিবেচিত হচ্ছে। ডিজিটাল পুতুলনাচের কাহিনীতে যে অদ্ভুত ঘটনাগুলো দেখানো হচ্ছে তাতে দর্শক-শ্রোতারা দিনকে দিন অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছে। একটি ঘুষি বা লাথি দিয়ে প্রতিপক্ষকে আসমানের তারার রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া অথবা তারার রাজ্য থেকে মাটিতে পড়ে বিশাল এক গর্ত তৈরি করার পরও অক্ষত থাকার ঘটনা দেখতে দেখতে মানুষের মন এতটাই শক্ত ও নির্লিপ্ত হয়ে গেছে যে, দু-চারটি কিল-ঘুষিকে তারা কোনো ঘটনাই মনে করে না এবং মানুষের বেদনার অশ্রু তাদের হৃদয়ে ভাবাবেগ সৃষ্টি করে না; কারণ ডিজিটাল পুতুলগুলো তো কখনো কাঁদে না। লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর