বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

নৃশংস নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীরা

পাঁচ বছরে ১৮২ জনের মৃত্যু

জয়শ্রী ভাদুড়ী

নৃশংস নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীরা

দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটাতে আমেনাকে (১০) ফেনীর আফরোজা বেগমের বাসায় কাজ করতে দিয়েছিল তার ফুপু। কিছুদিন পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায় আফরোজার মেয়ে লাভলীর বাসার কাজে সাহায্য করতে। খাবার না জুটলেও আমেনার কপালে জোটে বর্ণনাতীত নির্যাতন। লাভলীর নির্যাতনে ঝলসে যায় আমেনার পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান। দগ্ধস্থানে ধরেছে পচন। এ অবস্থায় তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে তাকে রাস্তা থেকে হাসপাতালে ভর্তি করেন এক ব্যক্তি। এরপর বেরিয়ে আসে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র।  

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে নৃশংস নির্যাতনে মারা গেছে ১৮২ জন গৃহকর্মী। সম্প্রতি উন্নয়ন অন্বেষণের ‘ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স : ডিভ্যালুয়েশন অ্যান্ড ডিসক্রিমিনেশন’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু গৃহকর্মী দৈনিক ৯ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করে। ১২ শতাংশ শিশু গৃহকর্মীর কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অথচ একজন শিশু গৃহকর্মী মাসে গড়ে ১ হাজার ১৮৫ টাকা মজুরি পায়। কারও কারও কপালে তাও জোটে না। পায় না ঠিকমতো খাবার, পোশাক, থাকার জায়গা এবং চিকিৎসা। প্রাপ্তবয়স্ক গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রেও একই দশা।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান     মন্ত্রণালয়ের চাইল্ড লেবার মনিটরিং সেলের কো-চেয়ার অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে প্রণিত নীতিমালাকে কার্যকর করতে হবে। যখন নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে যায় তখন তা আমাদের সামনে আসে। এ ছাড়া এরকম অসংখ্য নির্যাতনের চিত্র রয়ে যায় অন্তরালে। এসব মামলায় ক্ষতিপূরণ দিয়ে আপোস করে ফেলা হয়। কিন্তু এ নির্যাতন বন্ধে প্রয়োজন মনিটরিং এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

আইন ও শালিস কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ২২ জন গৃহকর্মী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পরে মারা গেছেন ৪জন। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে একজনকে। এ ছাড়া রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের। গৃহকর্মীরা ঘরের ভিতরে নির্যাতনের শিকার হলেও তা রয়ে যায় চার দেওয়ালের ভিতরে। কেউ জানতে পারে না প্রতিদিনের অবর্ণনীয় এই নির্যাতন। দরিদ্র পরিবারগুলো অনেকটা বাধ্য হয়েই শিশুদের মানুষের বাসায় কাজে দেয়। বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, শিশুদের নামমাত্র মজুরি বা বিনা মজুরিতে কাজ করানো হয়। নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তা দেখারও কেউ নেই।

নয় বছর বয়সে জান্নাতুল ফেরদৌস কাজ করত গাজীপুরের এক বাসায়। ঈদে চাঁদপুরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার বায়না ধরলে নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে। পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গরম খুন্তি ও বিদ্যুতের তারের আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন। টাইলসের সঙ্গে মাথা লাগিয়ে নির্যাতন করায় মাথায় বেশ ক্ষত।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের তোফাজ্জল আলীর মেয়ে সুমাইয়া খাতুন। অভাবের সংসারে আট বছর বয়সে বাবা মারা গেলে পথে বসে পরিবার। তখন পেটের দায়ে গ্রামের মোয়াজ্জেম আলীর কথায় কাজ নেয় রাজধানীর বাড্ডা এলাকার রফিকুল ইসলামের বাসায়। কয়েকদিন যেতেই কথায় কথায় শুরু হয় অকথ্য গালিগালাজ। কয়েক মাস পার হতেই গরম খুন্তি, বেলনা ছাড়াও হাতের কাছে যা পায় তা দিয়েই সুমাইয়াকে মারধর করেন গৃহকর্ত্রী। একদিন রাত ১১টায় ডিম ভাজি করতে বলে সুমাইয়াকে। ভাজতে গিয়ে একটু পুড়ে যাওয়ায় গরম কড়াই দিয়ে ছ্যাঁকা দিলে বাঁচার জন্য চিৎকার দেয় সে। তার চিৎকার শুনে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী পুলিশে খবর দিলে তারা এসে গ্রেফতার করে রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রীকে। এ রকম নির্যাতন হরহামেশাই চলছে রাজধানীসহ সারা দেশের গৃহকর্মীদের ওপর। কমেনি গৃহকর্মী নির্যাতন। মানবতা বা নীতিমালা কোনো কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না গৃহকর্মী নির্যাতন। বরং দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে নির্যাতনের ধরন ও নৃশংসতা। অসহায় এই পরিবারের শিশুরা অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হলেও করা হয় না মামলা। কেউ আবার মামলা করলেও অর্থের বিনিময়ে করে নেয় আপোস।

এ ব্যাপারে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ সব ঘটনায় মামলা গৃহকর্মীর পরিবার না করলে রাষ্ট্রকে করতে হবে। এ ঘটনায় আপোসের ব্যবস্থা বন্ধ করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। যে বাড়িতে নির্যাতন হয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনলে এবং বিচারের সংস্কৃতি সচল থাকলে এ ঘটনাগুলো কমে যাবে। এ সব মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। তাই গৃহকর্মী নির্যাতন করে পার পেয়ে যাওয়ার এই বিষয়ে সবার সজাগ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

জানা যায়, দেশে বিভিন্ন বয়সীে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। কাজে মন নেই অজুহাতে মারধর, যৌন হয়রানি, খেতে না দেওয়া গৃহকর্মী নির্যাতনের পুরনো চিত্র। কিন্তু এখন এসব নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নৃশংসতা। এমনকি মারতে মারতে মেরে ফেলার ঘটনা এখন প্রায় উঠে আসছে গণমাধ্যমে। গত ২৮ মার্চ মিরপুরের একটি বাসা থেকে বুলি (১৭) নামের এক গৃহকর্মীকে উদ্ধার করে শাহ আলী থানা পুলিশ। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর মারধরে গুরুতর আহত হয়েছিল সে। পরবর্তীতে ওসিসিতে তাকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সে জানায়, আড়াই বছর ধরে গৃহকর্তা এবিএম হাসানুজ্জামান ও গৃহকর্ত্রী  রেহেনা আক্তারের বাসায় কাজ করতো। দীর্ঘদিন তাকে নির্যাতন করে আসছিলেন তারা। এমনকি বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলতে দিত না। নানা কারণে তাকে মারধর করা হতো। তার শরীরে রয়েছে অনেক নির্যাতনের চিহ্ন। এ ঘটনায় নিজেই বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছে বুলি।

এ ব্যাপারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের ভাইস- চেয়ারম্যান শিরিন আক্তার এমপি বলেন, সমাজে শোষণ, বঞ্চনা থাকলে নীতিমালা করেও নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। সমাজব্যবস্থাকে পাল্টাতে গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধ করতে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং নীতিমালাকে বাস্তবায়ন করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সর্বশেষ খবর