বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রকে সব মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে

— সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাষ্ট্রকে সব মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘যে মেহনতি মানুষের শ্রমে-ঘামে টিকে আছে আমাদের এই রাষ্ট্র, তাদের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা। শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি, কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দামটুকুও নিশ্চিত করা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের যে রাষ্ট্র আমরা কায়েম করতে চেয়েছি, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সব মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।’ গতকাল রাজধানীর পল্টনে মুক্তিভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। অক্টোবর বিপ্লব শতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির আয়োজনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রতিদিন নারী নিপীড়ন-নির্যাতন-ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। পাহাড় ও সমতলে বিভিন্ন জাতিসত্তা আজ নিপীড়নে বিপন্ন। তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়েছে, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ দেশকে এক ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উন্নয়নের নামে চলছে লুটপাটের মহোৎসব। পাচার হয়ে যাচ্ছে জাতীয় সম্পদ। তিনি বলেন, কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে মত প্রকাশের অধিকারের। মানুষের অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেই রাষ্ট্রে আজ মানুষের মৈত্রী ও ইনসাফের সমাজ গঠন করতে হবে। বর্তমানে যে লুটপাটের রাজনীতি চলছে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন চলছে, তাতে মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা কোনো দিন বাস্তবায়ন করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে হলে সব মানুষের এ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, বুর্জোয়া ধারার দুটি জোটের কাঠামোতে দেশকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তারা উভয়েই লুটেরা পুঁজিবাদের সেবাদাস। দেশকে সংকটমুক্ত করতে হলে এ ধারার বিপরীতে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা আজ অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে। এ শক্তির বিকাশের প্রয়াসে অক্টোবর বিপ্লব অনিঃশেষ প্রেরণার উৎসধারা হয়ে আছে এবং থাকবে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের দিকে তাকালে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে জাতীয়তাবাদী ধারার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক ধারাও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রীরাই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার আওয়াজ তোলেন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, প্রাণপ্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন এবং তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তারা ছিলেন চালিকাশক্তি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক ধারার দুর্বলতার সুযোগে আমাদের এ দেশ জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা লুটেরা পুঁজিবাদী ধারায় পরিচালিত হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিপরীতে বৈষম্য বেড়েছে, বেড়েছে দুর্নীতি ও লুটপাট। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়নি লাখো শহীদের বাংলাদেশ। এমনকি ন্যূনতম নির্বাচনী গণতন্ত্রও আজ অনুপস্থিত। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরিবারতন্ত্র। পুনরুত্থান ঘটেছে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ও সাম্প্রদায়িক শক্তির। প্রবীণ এই অধ্যাপক বলেন, বহুকাল ধরে মানুষ সাম্য, মৈত্রী, ইনসাফের যে সমাজের স্বপ্ন দেখে এসেছে, রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব সেই স্বপ্নকেই বাস্তবায়ন করার কাজ করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে মানুষকে দিয়েছে আশা ও অগ্রযাত্রার পথের দিশা। মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অক্টোবর বিপ্লব মানব সভ্যতায় সূচনা করেছিল এক নতুন যুগের। অক্টোবর বিপ্লব পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করে। সৃষ্টি করে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের এক নতুন আন্তর্জাতিকতা। শতাব্দী পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওই বিপ্লবের ঐতিহাসিক তাত্পর্য একবিন্দুও মলিন হয়নি। বরং বর্তমান বিশ্বের গাঢ় অন্ধকারের পটভূমিতে তা আরও উজ্জ্বল ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজফার হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় কমিটির সমন্বয়ক হায়দার আকবর খান রনো, সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯ মে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় ‘অক্টোবর বিপ্লব শতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’। এ কমিটি কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় আগামী অক্টোবরের ১ তারিখ অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচি শুরু হবে। ৭ নভেম্বর একটি মহাসমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিলের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশের প্রগতিশীল শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, ছাত্র, যুব, নারী, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ঢাকায় সভা-সমাবেশ, প্রদর্শনী, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানামাত্রিক কর্মসূচি পালন করবে। অক্টোবর বিপ্লবের তাত্পর্য সব মানুষের কাছে তুলে ধরে এ দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যেই এই জাতীয় কমিটি কর্মসূচি পালন করবে বলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান।

সর্বশেষ খবর