বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
ঢাকায় প্রধান সমস্যা বাজেট ও নগর সরকার না থাকা, বললেন দুই মেয়র

যানজটে প্রতিদিন ক্ষতি ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা : বিশ্বব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী ঢাকায় ১০ বছর আগে যানবাহন চলাচলের গতি ছিল প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যা পায়ে হেঁটে চলার গড় গতি থেকে সামান্য বেশি। এ ছাড়া ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন গড়ে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এমন তথ্য উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায়। গতকাল হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংক আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক কর্মশালায় ‘টুওয়ার্ডস গ্রেট ঢাকা : এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইস ইস্টওয়ার্ড’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের খসড়া প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন। এ ছাড়া উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক, নগর পরিকল্পনাবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বেসরকারি খাত-সংশ্লিষ্টরা আলোচনায় অংশ নেন। এর আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি ভেনাবল্স ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার উন্নয়নের জন্য চারটি বিকল্প কর্মপন্থা উপস্থাপন করেন। সেগুলো নিয়ে কাজ করার তাগিদ দেন বক্তারা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ঢাকার রাস্তা বেড়েছে পাঁচ শতাংশ। আর জনসংখ্যা বেড়েছে ৫০ শতাংশ। একই সময়ে যান চলাচল বেড়েছে ১৩৪ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, এ অবস্থা চলতে থাকলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যানজট ও বাসযোগ্যতার পরিবেশের আরও অবনতি ঘটাবে ঢাকায়, যা বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ফেলবে বাসিন্দাদের। কেন্দ্র থেকে উত্তর দিকে এবং এরপর পশ্চিমাভিমুখে সম্প্রসারিত হয়েছে ঢাকার নগরায়ণ। মহানগরীর পূর্ব দিকে বেশির ভাগ এলাকা এখনো গ্রামীণ, তবে দ্রুত বিকাশের সুযোগ রয়েছে। পূর্ব ঢাকা ও গুলশানের মতো সমৃদ্ধ এলাকার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত মহানগরীর প্রায় ৪০ শতাংশ। যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ব ঢাকাকে নানা সুবিধাসহ একটি প্রাণচঞ্চল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, যা মূল শহরের অন্যান্য অংশের ভিড় ও যানজট কমাতে সহায়ক হবে। এতে আরও বলা হয়, ঢাকার পরিবেশ রক্ষায় এখনই সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। অন্যথায় দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে পূর্ব ঢাকাও যানজটে অচল ও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, যা স্থানীয়দের বন্যা ও ভূমিকম্পের ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। অনুষ্ঠানে উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলেন, রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা বাজেট ঘাটতি এবং নগর সরকার না থাকা। বিশ্বের শীর্ষ ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি ঢাকা। এর জন্য যে বাজেট দরকার তা বরাদ্দ দেওয়া হয় না। যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বিশ্বব্যাংককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। আনিসুল হকের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও রাজধানীর বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। এর মধ্যে অপ্রতুল বাজেট, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, জন-অসচেতনতাকে অন্যতম সমস্যা বলে তিনি উল্লেখ করেন। এখন পর্যন্ত নগর সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, নগর সরকার নেই বলে বিভিন্ন সংস্থা সমন্বয়হীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর এ কারণেই নগরের সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাচ্ছে না। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে সারা দিনেও শেষ করা যাবে না। তবে আমাদের এখন উচিত, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করা।’

ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি চিমিয়াও ফান বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার লোকসংখ্যা দাঁড়াবে তিন কোটি ৫০ লাখে। বিপুল এ জনসংখ্যাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে উৎপাদনশীল ও বাসযোগ্য মহানগরী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। উন্নত মহানগরীর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ঢাকাকে নিয়ে অবশ্যই সঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সব সংস্থার কাজের সমন্বয় সাধন এবং বিনিয়োগের সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে বিশ্বব্যাংক ঢাকাকে সমৃদ্ধ মহানগরী হিসেবে রূপান্তরে সহায়তা করতে সর্বদা প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত মহানগরীর উদাহরণ টেনে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মার্টিন রামা বলেন, পূর্ব সাংহাইয়ের পুদং এলাকা ও অন্যান্য স্থান প্রমাণ করে, যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে যানজট নিরসন সম্ভব। এর মাধ্যমে সেখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির পাশাপাশি বসবাসের উন্নত পরিবেশও নিশ্চিত করা সম্ভব। দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত ও চীনের সাংহাইয়ের সাবেক মেয়র কিঝেং ঝাও অনুষ্ঠানে দিল্লি ও পূর্ব সাংহাইয়ের পুদং এলাকার উন্নয়নের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। ওই দুই মহানগরীর একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বয়ের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বমূলক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নত ঢাকা গঠনে তাগিদ দেন বক্তারা। নগর উন্নয়ন-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার যে মহামারী চলছে, সেটি হয়েছে নগরের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে। ড্রেনেজ ব্যবস্থপনায় যথেষ্ট মনোযোগের অভাবে এ রকম রোগ-ব্যাধি ও জলাবদ্ধতার মতো নাগরিক সংকট তৈরি হচ্ছে। পরিবহন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় যানজটে নষ্ট হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টা। এ রকম বেশ কিছু মৌলিক নগরসেবার সংকটের কথা তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকাকে নতুন করে রূপান্তরের পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, যথাযথ ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ, পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। এ জন্য নিজস্ব পরিবেশ-সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন দেশের সফল নগরের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। তাদের মতে, সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের মধ্যে এ ধরনের মডেল অনুসরণ করা হলে ঢাকা হতে পারে দিল্লি কিংবা সাংহাইয়ের মতো সফল নগরী। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে অবকাঠামো উন্নয়ন করা যেতে পারে। অনুষ্ঠানে উন্নয়ন-সহযোগীদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর