শুক্রবার, ২১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

আগাম প্রস্তুতি নেই, বন্যায় বাড়ছে দুর্ভোগ

বর্ষা এলেই শুরু হয় বাঁধ নির্মাণের কাজ পানি কমলেও খাবার আর বিশুদ্ধ পানির অভাব

মাহমুদ আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

আগাম প্রস্তুতি নেই, বন্যায় বাড়ছে দুর্ভোগ

আগাম প্রস্তুতির অভাবে দেশের প্রায় ১৯টি জেলার বন্যা পরিস্থিতি রূপ নিয়েছে দুর্যোগে। অব্যাহত বৃষ্টি আর উজানের পানিতে বিপর্যস্ত ওই সব এলাকার মানুষ। প্রতি বছর বন্যা নদী, হাওর আর জনপদ ভাসিয়ে দিলেও এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি রুখতে সরকারের আগাম কোনো পরিকল্পনা নেই। তাই বন্যায় জীবনহানি, ফসলহানি ও সম্পদহানি হলেও টনক নড়ে না কর্তৃপক্ষের। হাওর যখন ডুবছিল তখন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে ব্যস্ত ছিলেন। এদিকে বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কিছু এলাকায় ভাঙছে নদী। বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার আর বিশুদ্ধ পানির অভাবে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

বসতভিটা হারিয়ে বাঁধের ওপর বা আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন তারা। কিন্তু সেই বাঁধেও দেখা দিয়েছে ফাটল। জানা যায়, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে সিলেট, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রাজবাড়ীসহ আরও বেশ কিছু জেলা। কিছু এলাকার বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। আর ফসল ডুবে যাওয়ায় বছরের খোরাক নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দুর্গতরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘দেশে প্রতি বছরই বন্যা হানা দেয়। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) শুষ্ক মৌসুমে কাজ শুরু ও শেষের পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এতে কাজ দৃশ্যমান হবে এবং পরিমাপ করা যাবে। পাশাপাশি বন্যার আগাম প্রস্তুতিতে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে।’ লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ড্রোন ব্যবহার করে যদি বন্যার আগেই সার্বিক চিত্র পর্যবেক্ষণ করা যায়, তাহলে সরকারের প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, চলতি বোরো মৌসুমে সারা দেশে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৯১ লাখ ৫৩ হাজার টন। কিন্তু এর মধ্যে ছয় জেলার হাওরের ২ লাখ হেক্টরের বেশি জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার জমি থেকে এবার ১ ছটাক ধানও পাওয়া যাবে না। ফলে কমপক্ষে ৮ লাখ টন ধান কম উৎপাদন হবে, যা উৎপাদনের মোট লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা শঙ্কা প্রকাশ করেন। হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফরমের তথ্যানুযায়ী, ধানে মোট ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৩৯১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সিলেটে ৪৫০, সুনামগঞ্জে ১ হাজার ৯৬৫, হবিগঞ্জে ৬৬১, নেত্রকোনায় ৪৬৩, মৌলভীবাজারে ২৪৬, কিশোরগঞ্জে ৬০০ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় মসুর, খেসারি, মরিচসহ নানা ধরনের রবিশস্য পানিতে নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বন্যায় বৃহত্তর সিলেটসহ ছয় জেলার ১৫ হাজার ৩৪৫টি ঘরবাড়িসহ ৮ লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, হাওরের বন্যায় ৪৬টি জলাশয় ক্ষতিগ্রস্ত এবং ২১ হাজার ৩৯৫ মেট্রিক টন মাছ, ৩ হাজার ৬০২টি হাঁস ও ৪টি মহিষ মারা গেছে। হাওরে বন্যার ক্ষতির চিত্র দেখে সারা দেশের ক্ষতির বিষয়টি অনুমান করা যায়।

বর্ষায় শুরু হয় বাঁধ নির্মাণের কাজ : হাওর এলাকার বৃহৎ একটি অংশ রয়েছে নেত্রকোনায়। জেলার ১০ উপজেলার বেশির ভাগই হাওর অংশে। হাওর এলাকা হিসেবে নেত্রকোনায় প্রতি বছরই বাঁধ মেরামত ও ফসল রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে বরাদ্দ আসে। আর এসব বরাদ্দের কাজ ঠিকাদার এবং পিআইসির মাধ্যমে হয়ে থাকে। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর জেলার ফসলরক্ষা বাঁধ ও ডুবে যাওয়া বাঁধের ২৭২ কিলোমিটার মেরামতের জন্য বরাদ্দ আসে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর নভেম্বরে কাজ শুরু করে এ বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষের নির্দেশনা দেওয়া হয়। অথচ কাজ শেষ তো দূরের কথা, স্থানীয় সংসদ সদস্যের মনোনয়নে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে সদস্যসচিব, তার স্ত্রীকে সভাপতি ও শ্যালককে সদস্য করে ছয়জনের কমিটি অনুমোদিত হয় ২ ফেব্রুয়ারি। যেখানে কাজ শেষ করার কথা ছিল সেখানে শুরুর তারিখ করে মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ মার্চ শেষ করার দিন ধার্য হয়। কিন্তু এর পরও নতুন তারিখ অনুযায়ী কাজ শেষ করতে পারেননি তারা। মার্চের মাঝামাঝি বৃষ্টি শুরু হলে তড়িঘড়ি করে বালুর বস্তা ফেলা হয়। ২৭ মার্চ পুরোদমে বৃষ্টি শুরু হলে ৩১ মার্চ রাতে পানির বেগে জালালের কুড় পয়েন্টের বালুর বস্তা সব ভেসে যায়। এর ফলে পানি ঢুকে পড়ে ডিঙ্গাপোতা হাওরে। এরপর এক এক করে কীর্তনখোলাসহ বিভিন্ন বাঁধ ভাঙতে থাকে। ডুবে যায় সব হাওরের ফসল।

এ ব্যাপারে নেত্রকোনা পাউবোর প্রকৌশলী আবু তাহের বলেন, ‘আমি যখন কমিটি পেয়েছি তখনই অনুমোদন দিয়েছি। ২ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন দিয়ে কাজের মেয়াদ ৩১ মার্চ করা হয়। এ বছর পাহাড়ি ঢলে বাঁধটি ভেঙে গেছে।’ কাজ ঠিকমতোই সম্পন্ন হয়েছিল বলে তিনি জানান। সিরাজগঞ্জে শতাধিক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন চৌহালী উপজেলা রক্ষা বাঁধে এবারসহ মোট সাতবার ধস নেমেছে। বাঁধ তদারকের দায়িত্বে থাকা টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ জানান, বুধবার ভোরে বাঁধের খাসকাউলিয়া অংশে ২০ মিটার ধসে যায়। চৌহালী উপজেলার পৌনে ৪ কিলোমিটার ও টাঙ্গাইলের সোয়া ৩ কিলোমিটার এলাকা যমুনার ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ১০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। টাঙ্গাইল সদরের সরাতৈল থেকে দক্ষিণে নাগরপুর উপজেলার পুকুরিয়া, শাহজানীর খগেনের ঘাট, সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ঘোরজানের চেকির মোড়, আজিমুদ্দি মোড়, খাসকাউলিয়া, জোতপাড়া পর্যন্ত বাঁধের কাজ ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর শুরু হয়। মাটি ফেলে জিও টেক্স ও ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয় বাঁধ। এর ওপর পাথরের ড্রেসিং শেষে সিসি ব্লক বিছানো হয়। এরপর ধসে যায় বাঁধ। নির্মাণাধীন বাঁধটিতে আড়াই মাসে সাতবার ধস নামায় এলাকার মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।

ধসের কারণ জানতে চাইলে প্রকৌশলী শাহজাহান বলেন, ‘নির্মাণকাজ প্রায় ৯৫ শতাংশ শেষ হওয়ার পর আড়াই মাসে সাতবার ধস নামায় আমরাও বিব্রত। প্রধান প্রকৌশলী ও পাউবোর মহাপরিচালককে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। এ এলাকার মাটির ধারণক্ষমতা কম। আর নদীতে বেশি পানির কারণে তলদেশে ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণে ধস নামছে।’

বন্যাকবলিত এলাকায় দুর্ভোগ : বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় নেমেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। খাবারের অভাবে অনাহারে কাটছে তাদের দিন-রাত। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ময়লাপানি পান করে রোগে-শোকে জর্জরিত এলাকার মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল বলছেন দুর্ভোগে পড়া মানুষ। ১০ দিনের বেশি সময়ের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামালপুর জেলার সাত উপজেলার যোগাযোগব্যবস্থা। পানির তোড়ে ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়েছে জেলার ৩১৮ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি। এবারের বন্যায় প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে কমলেও এখনো বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখনো বসতবাড়িতে পানি থাকায় কেউ ঘরে ফেরেনি। সরকারি তথ্যানুযায়ী, মাত্র কয়েক দিনের বন্যায় জেলার ৫০টি ইউনিয়নের ২৪৭ গ্রাম ও ৫০ হাজার পরিবারের আড়াই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদী ভাঙনে আড়াই হাজার বসতভিটা ও ৩০ হাজার বসতবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছয়টি বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বন্যাকবলিতরা এখনো ঘরে ফিরতে পারেননি। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন বানভাসিরা। চলতি বন্যায় এ পর্যন্ত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ৫ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। শতাধিক গ্রামের ১ লাখ পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছে। লোকালয় থেকে পানি কমতে শুরু করায় নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বন্যা দেখা দেয়। বন্যার আগাম প্রস্তুতি থাকায় বগুড়ায় এবার ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক এবং সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, মৌলভীবাজার ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি]

সর্বশেষ খবর