শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
মামলাকারী আওয়ামী লীগ নেতা বহিষ্কার

ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় তোলপাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও বরিশাল

ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় তোলপাড়

বরিশালের আগৈলঝাড়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (বর্তমানে বরগুনা সদর উপজেলায় কর্মরত) গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে মামলা ও গ্রেফতার প্রক্রিয়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইউএনওর হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো নিয়ে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে মাঠ প্রশাসনে। একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়। এদিকে মামলার বাদী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল বিকালে রাজধানীর গণভবনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান। জানা যায়, তারিক সালমান বরিশালের আগৈলঝাড়ার ইউএনও থাকাকালে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে একটি আমন্ত্রণপত্র ছাপান। সে আমন্ত্রণপত্রের পেছনে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করে ছাপানো হয়েছে বলে অভিযোগ আনেন জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। তিনি ৭ জুন ইউএনওর বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেন। ওই দিনই মামলাটি আমলে নিয়ে আদালতের বিচারক ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে তারিক সালমানকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সমন জারির আদেশ দেন। গত বুধবার আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইলে প্রথমে তা নাকচ হলেও দ্বিতীয়বার তারিক সালমানের জামিন মঞ্জুর করা হয়।  বৃহস্পতিবার পত্র-পত্রিকায় এ খবর দেখে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মকর্তারাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। ঘটনার পরপরই তারা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা সবাই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যত কর্মকর্তা ছিলেন, এটি দেখে বিস্মিত হয়েছি। যে ব্যক্তি এ মামলা করেছেন, তিনি অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ করেছেন। এইচ টি ইমাম জানান, তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে একজন ইউএনওকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার ছবিটি দেখান। এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে বলেন, ছবিটি দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ক্লাস ফাইভের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এ অফিসার সুন্দর একটি কাজ করেছেন। সেখানে যে ছবিটি আঁকা হয়েছে, সেটি আমার সামনেই আছে, আপনারা দেখতে পারেন এবং এ ছবিটিতে বিকৃত করার মতো কিছু করা হয়নি। এটি রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। এ অফিসার রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীকে কীভাবে গ্রেফতার করা হলো কোনো রকম অনুমোদন ছাড়া? এ প্রশ্নের উত্তরে এইচ টি ইমাম বলেন, এটি করা যায় না। কারণ, ইউএনও হচ্ছেন উপজেলা পর্যায়ে সরকারের সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাকে কোনো শাস্তি দিতে হলে বা তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা কোনো রকম কিছু করতে হলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। এইচ টি ইমাম এ ঘটনার জন্য বরিশালের ডিসি-এসপিকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, পুলিশ যে ব্যবহার করেছে এই ছেলেটির (ইউএনও) সঙ্গে, যেভাবে তাকে নিয়ে গেছে, এ নিয়ে আমি ওখানকার ডিসি, এসপি, এদের প্রত্যেককে দায়ী করব। এদের বিরুদ্ধেও আমাদের বোধহয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ বিষয়ে ইউএনও তারিক সালমান সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি কোনো রকম বিকৃত করে প্রকাশ বা প্রচার করা হয়নি। বরং শিশুরা যাতে জাতির জনককে হৃদয়ে ধারণ করে তার আদর্শে বড় হতে পারে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে শিশুদের আঁকা ছবি ব্যবহার করে মহান স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রটি ছাপা হয়েছিল।  এদিকে এ ঘটনার নেপথ্য কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, ব্যক্তি আক্রোশ থেকেই ইউএনওকে মামলার আসামি করা হয়েছে। ইউএনও গাজী তারিক সালমান প্রশাসনিক কাজে খুবই কঠোর ও আন্তরিক ছিলেন। এ জন্য তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হন কেউ কেউ। সূত্র জানায়, টিআর-কাবিখা প্রকল্পের আওতায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আগৈলঝাড়া উপজেলায় সোলার প্যানেল স্থাপনে বরাদ্দ দেওয়া ৭৯ লাখ টাকা ফেরত পাঠান ইউএনও তারিক সালমান। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ওই টাকা নিজেদের মতো করে খরচ করতে চেয়েছিলেন। এসব ঘটনায় তারিক সালমানের ওপর ক্ষুব্ধ একটি মহলের ইন্ধনে মামলাটি হতে পারে।  এদিকে বরিশালের জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেন, এটি জামিনযোগ্য ধারার মামলা। আবেদন করলে দুই মিনিটের মধ্যে জামিন হয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে দুই ঘণ্টা হাজতবাস করানো হয়েছে। তার আগে জামিন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব করা, বিচার বাধাগ্রস্ত করা এবং হাতকড়া পরানো চরম আইনের লঙ্ঘন হয়েছে।  বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় আদালতের বিচারক মো. আলী হোসাইন আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুরের মৌখিক আদেশ দেন। এর পরপরই আদালতে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ইউএনও তারিক সালমানকে হাত ধরে টেনে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যান।  গাজী তারিক সালমান বলেন, আদালতের কাঠকড়া থেকে নামানোর পর পুলিশ সদস্যরা তার হাতে হাতকড়া পরাতে উদ্যত হয়েছিল। তখন তিনি তাদের হাতকড়া না পরানোর অনুরোধ করেন। তখন পুলিশের এক সদস্য একটি হাতকড়াসহ তার (সালমান) ডান হাত চেপে ধরে এবং অপর হাত চেপে ধরে পুলিশের আরেক সদস্য। এ সময় ফের তিনি পুলিশ সদস্যদের টানাহেঁচড়া না করতে অনুরোধ করলেও পুলিশ তাকে বলেছে, এটাই নিয়ম। এভাবেই নিতে হয়। বিষয়টি খুবই অপমানজনক ছিল বলে জানান তিনি।  এ ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন পরদিন বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশ হলে সারা দেশে সিভিল সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নাখোশ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এ ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী মামলা দায়েরকারী ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন।

 খোঁজ নিয়ে তারা জেনেছেন, ওই ব্যক্তি (মামলার বাদী সাজু) পাঁচ বছর আগে আওয়ামী লীগে ছিলেন না। দলে ঢুকে পড়া এই ‘অতিউৎসাহীরাই’ এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন। এদের চাটুকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরাই (চাটুকার) আওয়ামী লীগের ক্ষতি করছে। সন্ধ্যায় তার বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানালেন ওবায়দুল কাদের।

উল্লেখ্য, গত বছর ২৩ ডিসেম্বর অ্যাডভোকেট সাজু তার সহযোগীদের নিয়ে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের পাশে উজিরপুরের জয়শ্রীতে আগেভাগে তৈরি করে রাখা কাঠের অবকাঠামো দিয়ে ১৩টি দোকানঘর অবৈধভাবে স্থাপনের উদ্যোগ নেন। এ সময় অবৈধ দখলের ছবি তুলতে গেলে জহির খান নামে স্থানীয় এক সংবাদ কর্মীর ক্যামেরা ভাঙচুর করেন তারা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সরকারি জমি অবৈধ দখল এবং সাংবাদিকের ক্যামেরা ভাঙচুরের অভিযোগে অ্যাডভোকেট সাজু, তার সহকারী আইনজীবী সাইফুল এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সবুজসহ সাতজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। দিনভর নানা নাটকীয়তার পর জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের চাপে সাজুসহ আটক সাতজনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

সর্বশেষ খবর