রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

খাদ্য পাচার হঠাৎ সংকট ও অনিয়মে তোলপাড়

প্রশ্নবিদ্ধ খাদ্য অধিদফতর

নিজস্ব প্রতিবেদক

খাদ্যের মজুদ কমে যাওয়া, চট্টগ্রামে গুদাম থেকে চাল পাচার, সরকারি সিদ্ধান্ত অবজ্ঞা করে পাটের ব্যাগের পরিবর্তে আমদানীকৃত চালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারসহ খাদ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধে সরকারের ভেতরে-বাইরে আলোচনা চলছে। সরকারি দলের অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, খাদ্যের মতো স্পর্শকাতর এসব বিষয়ে খাদ্য অধিদফতরের নির্বিকার ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সরকারের বিশেষ মহলের সুনজরে থাকার কারণে তিনি কিছুই তোয়াক্কা করছেন না। তার উদাসীনতার কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশে খাদ্যের এমন সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সরকারকে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে চাল আমদানি করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, খাদ্য মজুদ বছরজুড়েই কমপক্ষে ১০ লাখ মেট্রিক টন থাকতে হবে। সেটা কোনোভাবে এর নিচে নেমে এলেই দ্রুত শূন্যতা পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় মারাত্মক খাদ্য সংকটে পড়ে যায় দেশ। খাদ্য অধিদফতরের একজন সাবেক মহাপরিচালক প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘কীভাবে এ সংকট তৈরি হলো তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। কারণ বছরজুড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল মজুদ থাকার কথা।’ তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, বর্তমান মহাপরিচালকের (ডিজি) অদূরদর্শিতার কারণে কিংবা তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চালের মজুদ কমে যাওয়া সম্পর্কে বোঝাক্ষে সক্ষম না হওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে।’

খাদ্য বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণত মার্চের দিকে মজুদের পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। যদিও সেটি ছয়-সাত লাখের নিচে নামে না। ওই সময়টায় বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরুর বিষয় মাথায় রাখা হয়। যতদূর জানি, এবারও মার্চ মাসে মজুদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো ছিল।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান ডিজি হয়তো ধরে নিয়েছিলেন মে মাসের দিকে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ শুরু হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ঘাটতিও পূরণ হতে থাকবে। কিন্তু পরিস্থিতি হয়েছে ভিন্ন, মার্চে এসে মজুদ কমার পাশাপাশি দেশের হাওরাঞ্চলে যখন বিপর্যয় দেখা দেয়। এ বিষয়টি ডিজির মাথায় রাখা উচিত ছিল, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অন্যান্য কারণে যদি বিপর্যয় দেখা দেয় তাহলে সংকট তৈরি হতে পারে। সেটা বিবেচনায় না নেওয়ার কারণে মার্চের শেষেই মজুদ তলানিতে নেমে যায় এবং সংকট তৈরি হয়। কিন্তু মে-জুন পর্যন্ত মজুদ না বাড়ানোর কারণে সেটি একেবারেই তলানিতে নেমে যায় এবং সংকট প্রকট হয়। যদি সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দ্রুততম সময়ে মজুদ বাড়িয়ে নেওয়া হতো, তাহলে সংকট তৈরি হতো না।’

জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত সরকারের খাদ্য মজুদের পরিমাণ দুই লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে চালের পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন, আর গম এক লাখ ৬৭ মেট্রিক টন। আর খাদ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত তথ্য অনুযায়ী, ১৭ জুলাই পর্যন্ত মজুদের পরিমাণ তিন লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল এক লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন ও গম এক লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। আর গত পাঁচ বছর খাদ্য মজুদের পরিমাণ এই সময়ে কখনোই পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের নিচে নামেনি।

খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খাদ্যের মজুদ বাগাতে না পারলেও অন্যান্য কাজে ঠিকই পারদর্শী। বাধ্যতামূলক পাটের ব্যাগ ব্যবহারের সরকারি সিদ্ধান্তকে অবজ্ঞা করে পলিথিন ব্যাগেই ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে খাদ্য অধিদফতর। সূত্র জানায়, বাধ্যতামূলক মোড়কীকরণ আইনে পাটের ব্যাগে ১৭ ধরনের খাদ্যপণ্য আমদানি-রফতানি করার সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক চাল আমদানিতে সেই আইন এবং সরকারের নির্দেশনা মানেননি। মহাপরিচালক মোড়কীকরণ আইন লঙ্ঘন করে  ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছেন পলিথিন ব্যাগে। অথচ বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল পাট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন। ডিজি মন্ত্রণালয় বা জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের এ আপত্তি আমলে নেননি। সূত্র জানায়, বর্তমান মহাপরিচালক বদরুল হাসান দায়িত্ব পাওয়ার পর অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। খাদ্য মজুদের পরিমাণ তলানিতে আসার পেছনে তার অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার পাশাপাশি অনিয়মের অভিযোগ আছে। তিনি খাদ্যের মজুদ বাড়ানোর চেয়ে সার্বক্ষণিক নিজস্ব বলয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ফলে আসল কাজে তার নজর নেই। সূত্র জানায়, মহাপরিচালকের চাপের মুখে মজুদের চাল বিক্রি করা হয় দেশের বিভিন্ন খাদ্যগুদাম থেকে। তিনি মজুদকৃত চাল বিক্রির জন্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের চাপ দেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চাপে পড়ে মজুদ চাল তারা বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে করেই সংকট তৈরি হয় বলে জানা গেছে।

এদিকে চট্টগ্রামের হালিশহর খাদ্যগুদাম থেকে পাচার হওয়ার সময় র‌্যাব অভিযান চালিয়ে যে চাল উদ্ধার করেছে তা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি এখন তদন্তের পর্যায়। জানা গেছে, ওই চাল চট্টগ্রামের কতিপয় ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। সময়-সুযোগ করে সেটি তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সময়ই ধরা পড়ে। এতে হালিশহর খাদ্যগুদামের ব্যবস্থাপক প্রণয়ন চাকমা ও সহকারী ব্যবস্থাপক ফখরুল ইসলাম জড়িত ছিলেন। খাদ্য বিভাগে কেন এত সংকট? এ প্রশ্নের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, সুপারসিড করে অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক করা হয়েছে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা বদরুল হাসানকে। আর তার কারণেই আজ মজুদের এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

সূত্র জানায়, ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা বদরুল হাসান ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। ছয় মাস যেতে না যেতেই তিনি হয়ে যান অতিরিক্ত সচিব। আর পদোন্নতি পেয়েই গত বছর ২৮ আগস্ট খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। তার এই দ্রুত পদোন্নতি ও নিয়োগ রহস্যময়। অথচ তার সিনিয়র অসংখ্য কর্মকর্তা ছিলেন, যারা অতিরিক্ত সচিব, অথচ পদ না পেয়ে ওএসডি কর্মকর্তা হিসেবে জনপ্রশাসনে পড়ে ছিলেন। তাদের নিয়োগ না দিয়ে বদরুল হাসানকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, বদরুল হাসান নানা কৌশলে সিনিয়রদের টপকে নিজেকে চাহিদামতো জায়গায় নিয়ে গেছেন। আর তার এ কাজে সহযোগিতা করেছেন খাদ্য অধিফতরের একজন পরিচালক এবং ঢাকার একজন আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা। তারাই তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্য অধিদফতরে বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটই তৈরি করছে নানা সংকট।

সর্বশেষ খবর