রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সবাই পাগল হয়ে যাইনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

সবাই পাগল হয়ে যাইনি

ড. কামাল হোসেন

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিজের অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের সমালোচনার জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘শুধু আমার একার যুক্তি ছিল না, আরও সাতজন সিনিয়র ল ইয়ার আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন, সাতজন জাজ পুরো একমত হয়ে রায়টি দিয়েছেন। আমরা তো সবাই পাগল হয়ে যাইনি।’ গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় আপিল বিভাগে বহাল রাখার পর এ নিয়ে সংসদ অধিবেশনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্যরা। তারা ড. কামালের ভূমিকারও কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কামাল হোসেন বলেন, তার যুক্তি তিনি লিখিতভাবে আদালতে উপস্থাপন করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা তার অপরিচিত কেউ নন। তারা চাইলে এই বক্তব্যের অনুলিপি তিনি তাদের কাছে পাঠিয়ে দেবেন।

গণফোরাম-প্রধান বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার বলেছিল, “সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এ নির্বাচন করতে হচ্ছে। পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে আমরা খুব শিগগিরই আলোচনা করব। সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করব।” সংবাদপত্রে এসব খবর প্রকাশিত হয়েছে। সে নির্বাচন নিয়ে আদালতেও প্রশ্ন উঠেছিল। তখন আমি পত্রিকায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করে বলেছি, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন সরকার যেহেতু বলছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন দেবে; সেহেতু তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত। এরপর সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেছে। আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অপেক্ষায় আছি আলোচনার। কবে তারা আলোচনার উদ্যোগ নেবেন, ডাক দেবেন, আমরা সেই অপেক্ষায় আছি। আশা করি সরকার আলোচনার উদ্যোগ নেবে।’ এর আগে সকাল ১০টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ড. কামাল হোসেন। সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু সভায় রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। দেশের ৩৫ জেলার প্রতিনিধিসহ শতাধিক মাঠ নেতা এতে অংশ নেন। বর্তমান বাস্তবতায় দলের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতেই মূলত বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়। সভায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ধিত সভায় একটি জোট গঠন করে ভোট করার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে মাঠ নেতারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি— এ দুই দলকেই লাল কার্ড দেখিয়ে এদের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীলদের নিয়ে নয়া জোট গঠনের দাবি জানান।

ড. কামাল বলেন, ‘বর্ধিত সভায় সবাই বলেছেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন। মানুষ বিরাজমান এ অবস্থার পরিবর্তন চায়। গণতান্ত্রিকভাবে এই পরিবর্তনের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজন। এ ছাড়া দলের সবাই গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পক্ষে একটি জাতীয় ঐক্য চায়।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের বিষয়ে কার্যকর গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। জনগণ ক্ষমতার মালিক, এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সেই জনগণকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে। নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্ব না থাকলে জবাবদিহিতা থাকে না। গণতন্ত্র ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। ভুয়া জনপ্রতিনিধি হলে রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা থাকে না। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাষ্ট্র কার মালিকানায় থাকবে? জনগণ কার মালিকানায় থাকবে? সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র জনগণের মালিকানায় থাকবে। অন্য কারও অধীনে থাকলে তা হবে অবৈধ।’ বর্তমান সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কিনা— জানতে চাইলে ড. কামাল বলেন, ‘যে কোনো সরকারের অধীনেই তা সম্ভব যদি নিরপেক্ষতা থাকে। নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক ব্যাপার। যারা নির্বাচন তদারকি করবে, তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে।’

বর্ধিত সভায় সভাপতির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আদালতের রায়ের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে দেশে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা চলছে। এ প্রবণতা সত্যিই দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘রায় নিয়ে সংসদে যেভাবে কথা বলা হয়েছে তা দুঃখজনক। এ নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে সংসদ সদস্যরা নিজে থেকেই প্রমাণ করেছেন, তারা কতটা অযোগ্য।’ বর্তমান সংসদের বেশির ভাগ সদস্যই বিনা ভোটের বলেও উল্লেখ করেন তিনি। প্রবীণ এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘বর্তমান সংবিধান বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি। এ সংবিধান ছুড়ে ফেলার ক্ষমতা তার মেয়েরও নেই। যারা এখন এ সংবিধান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমাদের চেয়েও বেশি মায়াকান্না দেখাচ্ছেন, তাদের অবস্থা “মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি”র মতো।’ এক প্রশ্নের জবাবে কামাল হোসেন বলেন, ‘এরা না জেনে না পড়ে সমালোচনা করছেন। বাহাত্তর সালে আমি কী বলেছি, আর এখন কী বলছি, মিলিয়ে নিন। তখনকার বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতা এক নয়, আমি সেটাই বলেছি। অন্যরাও একই কথা বলেছেন। তখন সংসদ সদস্যরা নিরপেক্ষ থাকবেন এই বিবেচনা থেকে করা হয়েছিল। সে বাস্তবতা এখন নেই।’ সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতিদের অপসারণক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার পক্ষে কিনা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কারণ বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের রেফারির দায়িত্ব পালন করে। রেফারি না থাকলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত কে রোধ করবে? সংবিধানেই বিচার বিভাগকে সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে। তারা সাংবিধানিক ব্যবস্থায় আম্পায়ারিং করেন। ফলে বিষয়টা সুপ্রিম জুডিশিয়ারির হাতে থাকলে রাষ্ট্রের চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রক্ষা হয়।’

সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু তার প্রতিবেদনে বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে সংকট বিরাজ করছে। না আছে গণতন্ত্র, না আছে আইনের শাসন, না আছে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ। দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সামনে নির্বাচন এ অবস্থায় কার্যকর গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের বিকল্প নেই। এজন্য আগামী সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।’ একইসঙ্গে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনী আইন ও ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কর্মসূচিভিত্তিক জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সংলাপ শুরু করার আহ্বান জানান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর