সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

হুমকিতে শাহজালালের প্রবেশমুখ

পাঁচ তারকা হোটেল, শপিং মলের কারণে যানজটে অচল হবে বিমানবন্দর

গোলাম রাব্বানী

হুমকিতে শাহজালালের প্রবেশমুখ

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কি অচল হয়ে পড়বে? মূল ফটক ঘেঁষে বিশাল পাঁচ তারকা হোটেল, শপিং মল এবং একটি তিন তারকা হোটেল নির্মাণ দেখে অনেকে এ প্রশ্ন করছেন। প্রায় ১৫ একর জমির ওপর এ প্রকল্পের কাজ শেষের পথে।

অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হওয়া এই শপিং মল, পাঁচ তারকা হোটেল চালু হলে বিমানবন্দরের প্রবেশপথ অচল হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এমনিতেই বিমানবন্দরের প্রবেশপথ সংকুচিত। শপিং মল, হোটেল চালু হলে সারাক্ষণ যানজটে আটকা থাকবে এই এলাকা। ফলে বিমানবন্দরে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি হুমকিতে পড়বে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা।

বিশ্লেষকদের মতে, বিমানবন্দর এলাকায় যানজটের কারণে এখনই চলাফেরা করা যায় না। এরপরও সামনে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হচ্ছে শপিং মল, পাঁচ তারকা হোটেল। এসব জায়গায় পার্কিং থাকার কথা। কিন্তু পার্কিংয়ের জায়গা না দিয়ে বানানো হচ্ছে হোটেল। আর হোটেল ও শপিং মল চালু হলে বন্ধ হয়ে যাবে বিমানবন্দরের প্রবেশপথ। পরিত্যক্ত হতে পারে বিমানবন্দর। ভবিষ্যতে সরকারের জন্য এটি হবে গলার কাঁটা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, হোটেল ও শপিং মলের কারণে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইপকো প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দরের প্রবেশপথের পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে বিশাল পাঁচ তারকা হোটেল। একই প্রকল্পের আওতায় সেখানে গড়ে উঠছে ৯ লাখ বর্গফুটের একটি আন্তর্জাতিক মানের শপিং মল। সঙ্গে আরও একটি তিন তারকা হোটেল। নিরাপত্তা শঙ্কা, যানজট ও ভবিষ্যৎ জায়গা সংকুলানের চিন্তা না করে এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণের যৌক্তিকতা নেই বলে জানিয়েছেন অনেকে।

 

সরেজমিন দেখা গেছে, নির্মাণাধীন হোটেল ও শপিং মলের কারণে বিমানবন্দরের একাংশ ঢেকে গেছে বললেই চলে। বিশেষ করে উত্তরা থেকে আসার পথে এখন বিমানবন্দরের পরিবর্তে আগে চোখে পড়ছে বিশাল এ অবকাঠামোটি। প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সিঙ্গাপুরভিত্তিক  কোম্পানি ইপকো বলেছে, হোটেল দুটি চালু হতে কিছু সময় লাগলেও দ্রুত শপিং মল চালু হয়ে যাবে। এদিকে বহুল আলোচিত এ প্রকল্প নিয়ে শেষ পর্যায়ে এসেও চলছে নানা সমালোচনা। দেশের অতিগুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরের পাশে এমন একটি স্থাপনা- কেউই মেনে নিতে পারছেন না। যৌক্তিক এবং বাস্তব সমস্যার কথা তুলে ধরছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এমন একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে কেউ যদি বিমান টার্গেট করে গুলি চালাতে চায়, তবে সেটি তেমন কোনো কঠিন কাজ হবে না। এ বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটির দায়িত্ব বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নয়, সেহেতু কড়া নিরাপত্তাও নিশ্চয়ই থাকবে না। বহু দেশে বিমানবন্দরভিত্তিক ফাইভ স্টার হোটেল ও শপিং মল থাকে, কিন্তু এত কম দূরত্বে গাঘেঁষে কোথাও এমন হতে দেখিনি। যেহেতু হোটেলে বসেই যাত্রীরা বিমানে চেক-ইনের সুযোগ পাবেন, সেহেতু লাগেজ চেকিং কতটা সুষ্ঠু ও কার্যকরী হবে তা নিয়েও সন্দেহ আছে।

ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইপকো প্রকল্প চালু হলে বিমানবন্দরের সামনের মহাসড়কে যানজট কয়েকগুণ বাড়বে। এ মোড়ে সারা দিন যানজট লেগেই থাকে। একদিকে বিমানবন্দর থেকে বের হন বিমানের যাত্রীরা, অন্যদিকে রাস্তার বিপরীতে রেলস্টেশন থেকে বের হন রেলের যাত্রীরা। আছে রেলক্রসিং সিগন্যাল। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ার প্রবেশমুখ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এ মহাসড়কটি। মহানগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী গণপরিবহনের চাপ তো আছেই। সব মিলিয়ে প্রতিদিন অসহনীয় যানজটে নাভিশ্বাস উঠে মানুষের। হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোটেল ও শপিং মল চালু হলে মানুষ ও পরিবহনের চাপ কয়েকগুণ বাড়বে। শপিং মল কিংবা  হোটেলে যাওয়া-আসার জন্য প্রধান সড়ক ছাড়া বিকল্প  কোনো পথের ব্যবস্থা না করায় মানুষের সমাগমে রাস্তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এতে অচল হয়ে পড়তে পারে বিমানবন্দরে যাতায়াতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিমানবন্দরে আগাগোড়াই চোরাচালান ও নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে। প্রায়ই সোনাসহ বিভিন্ন অবৈধ দ্রব্যের  চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসী হামলা থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ বিমানবন্দরকে সুরক্ষার ক্ষেত্রে এত অল্প দূরত্বে এমন একটি ‘পাবলিক প্লেস’ কতখানি যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরে ধারণক্ষমতার চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ও কার্গো বহন করা হচ্ছে। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বিমান যাত্রী বৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।

বিমানবন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ৬০-৬৫ লাখ যাত্রী বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করছেন। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে হারে যাত্রী বাড়ছে এতে ২০২০ সাল নাগাদ এর সংখ্যা দাঁড়াবে এক  কোটি। এক যুগ পর হবে অন্তত দেড় কোটি। তখন থার্ড টার্মিনাল দিয়েও কাজ হবে না। করতে হবে নতুন প্ল্যান, নতুন টার্মিনাল ও অবকাঠামো। তখন ইপকো প্রকল্পকে  দেওয়া ১৫ একর জমির জন্য আফসোস করা ছাড়া আর  কোনো বিকল্প পথ থাকবে না।  জানা গেছে, ২০০০ সালে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তখন ইপকো সিভিল এভিয়েশনের ১৫ একর জমির ওপর দুটি হোটেল ও একটি শপিং মল করার প্রস্তাব দেয়। এরপর বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প হিসেবে ইপকোকে জমি ভাড়া  দেয় সিভিল এভিয়েশন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা জটিলতায় কাজ বন্ধ থাকে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ফের এটি চালু হয়। যদিও শুরু থেকেই বিপক্ষে ছিলেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

সর্বশেষ খবর