সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিপর্যয় এইচএসসির ফলে

পাসের হার কমে ৬৮.৯১ I ৩৮ হাজার জিপিএ-৫

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিপর্যয় এইচএসসির ফলে

টানা উচ্চমাত্রায় সাফল্য দেখানোর পর উচ্চমাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে ছন্দপতন ঘটেছে। গতকাল প্রকাশিত ফলাফলে ১০ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ কম।

সংখ্যার হিসাবে এবার আগের বছরের চেয়েও প্রায় এক লাখ বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে। শুধু পাসের হার নয়, কমেছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। গত বছর এই ১০ বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। তবে এবারের এই ছন্দপতনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ড ও শিক্ষাবিদরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তীর্ণদের অভিনন্দন ও উত্তীর্ণ হতে না পারা শিক্ষার্থীদের পরবর্তী সাফল্যের জন্য অনুপ্রেরণা দিয়ে বলেছেন, ‘পরীক্ষায় কত পারসেন্ট পাস হলো আর কত পারসেন্ট পাস হলো না- তা বিচার-বিবেচনার বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সবাইকে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।’ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘এবার পাস কম করায় আমরা বিস্মিত হইনি। পরীক্ষার খাতা ভালোভাবে মূল্যায়ন করার কারণেই এ ফল হয়েছে। তাই এটা সাফল্য।’ জানা গেছে, গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয়ে মে মাসের মাঝামাঝি চলা এইচএসসি পরীক্ষায় ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, একটি করে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মোট ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭০ পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, এর মধ্যে পাস করেছে ৮ লাখ ১ হাজার ৭১১ জন। গত বছর ১০টি শিক্ষা বোর্ডে ১২ লাখ ৩ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছিল ৮ লাখ ৯৯ হাজার ১৫০ জন। পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। গত বছর থেকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪০ হাজার ২৭০ জন হলেও পাসের ক্ষেত্রে গত বছরের তুলনায় ৯৭ হাজার ৪৩৯ জন কম পাস করেছে। জিপিএ-৫ গত বছরের চেয়ে কমেছে ২০ হাজার ৩০৭টি। ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩৮ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৯৪২ জন। পাসের হার ৬৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গত বছর ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৭২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সে হিসাবে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ কমেছে পাসের হার। এসব বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৩ হাজার ২৪২ জন। গত বছরের তুলনায় জিপিএ-৫ কমেছে ১৫ হাজার ৭০৮টি। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে এ বছর ৯৬ হাজার ৮০২ জন ছাত্রছাত্রী আলিম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ৭৪ হাজার ৫৬১ জন। এ বছর পাসের হার ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। এ বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৮১৫ জন ছাত্রছাত্রী। গত বছরের চেয়ে জিপিএ-৫ প্রাপ্তি কমেছে ৫৯৯ জনের। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৯৭ হাজার ১৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ৭৮ হাজার ৯০৪ জন। পাসের হার ৮১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। কারিগরি বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ হাজার ৬৬৯ জন। গত বছরের তুলনায় জিপিএ-৫ কমেছে ৩ হাজার ৯১৮ জনের। বিদেশের ৭টি কেন্দ্র থেকে মোট ২৫৯ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ২৪৪ জন। পাসের হার ৯৪ দশমিক ২১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৬ জন। এবার ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করেছে। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এবার ২ দশমিক ৮২ ভাগ বেশি পাস করেছে। টেলিটক মোবাইল অপারেটর ব্যবহার করে মেসেজ পাঠিয়ে আজ থেকে আগামী ৩০ জুলাই পর্যন্ত ফল পুনঃনিরীক্ষণ করা যাবে। উল্লেখ্য, ফলাফলের অনুলিপি শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা গতকাল সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন। এরপর দুপুর ১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফলাফলের বিস্তারিত দিক তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী। দুপুর ২টার পর শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ওয়েবসাইট, নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বোর্ড-ওয়েবসাইট ও টেলিটক মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ফল জানতে পারে।

বাঁধভাঙা আনন্দ : এইচএসসির ফলকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন কলেজে ভিড় করতে থাকে শিক্ষার্থীরা। সকালের উদ্বেগ দুপুরে বাঁধভাঙা আনন্দে রূপ নেয়। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পাসের হার ৯৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। কলেজ থেকে মোট ১ হাজার ৮২১ ছাত্রীর মধ্যে ৩ জন বাদে সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে। এবার ছাত্রীদের মোট ৯৫৪ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ কলেজ প্রাঙ্গণে দেখা গেছে, উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস। দুপুরের বৃষ্টিও তাদের আনন্দে কোনো ভাটা ফেলতে পারেনি।

এগিয়ে সিলেট, ফল বিপর্যয় কুমিল্লায় : এইচএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে ফল বিপর্যয় হয়েছে। ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার যেখানে ৬৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ, সেখানে কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। শুধু তাই নয়, মানবিক শাখায় এ বোর্ডের পাসের হার মাত্র ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। পাসের হারে সবার শীর্ষে আছে সিলেট বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৭২ শতাংশ। অন্যান্য বোর্ডের মধ্যে পাসের হার ঢাকা বোর্ডে ৬৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৭১ দশমিক ৩০ শতাংশ, যশোরে ৭০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৬১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, বরিশালে ৭০ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৬৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

এগিয়ে মেয়েরা : ১০টি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হারে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা এগিয়ে। পরীক্ষায় ছাত্রীদের পাসের হার ৭০ দশমিক ৪৩ শতাংশ, আর ছাত্রদের পাসের হার ৬৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। গড় হিসেবে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাত্রী বেশি পাস করেছে। তবে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। এখানে এগিয়ে আছে ছাত্ররা। ২০ হাজার ৫৩৫ ছাত্র জিপিএ-৫ পেলেও ১৭ হাজার ৪৩৪ ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে।

শতভাগ ফেল ৭২ প্রতিষ্ঠানে : এ বছর ৭২টি প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। গত বছর এর সংখ্যা ছিল ২৫টি। শতভাগ ফেল এমন প্রতিষ্ঠান গত বছরের চেয়ে বেড়েছে ৪৭টি। শতভাগ পাস করেছে ৫৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গত বছর এর সংখ্যা ছিল ৮৪৮টি। শতভাগ শিক্ষার্থী পাসের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গতবার থেকে ৩১৬টি কমেছে।

গুণগত মানোন্নয়নের কথা প্রধানমন্ত্রীর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এ বছর এইচএসসির রেজাল্ট একটু খারাপ হলেও আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক করে গড়ে তুলে এর গুণগত মানের দিকে সর্্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রয়োগ করেছি। সব বিষয়ের প্রতি বিশেষ করে উত্তরপত্র মূল্যায়নে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।’ তিনি গতকাল সকালে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার ফলাফল গ্রহণ করার সময় এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী পরীক্ষায় পাস-ফেল নিয়ে না ভেবে শিক্ষার মান বাড়াতে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে এবং এই বয়সে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সঠিক গাইডলাইন দেওয়া। এ সময় ছেলেমেয়েরা যেন মাদকাসক্ত ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। ছেলেমেয়েরা নিজেদের কথাগুলো যেন বন্ধুর মতো বাবা-মাকে বলতে পারে- সে বিষয়ে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন তিনি। ফলাফল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষমতায় আসার আগে পাসের হার কী ছিল, আর এখন কী? তিনি বলেন, আমরা পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশের বিষয়টি একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসেছি। ফল পাওয়া নিয়ে এখন আর আগের মতো ঝামেলা পোহাতে হয় না। ঘরে বসেই এখন সবাই ফলাফল পেতে পারে।

সর্বশেষ খবর