সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিছানায় শুয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না

বাদল নূর

বিছানায় শুয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি ও উপমহাদেশের বাম রাজনীতির পুরোধাদের অন্যতম অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ৯৬ বছর বয়সী প্রবীণ এই রাজনীতিক অসুস্থতার কারণে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে শুয়ে-বসে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বিছানায় শুয়েই বেশির ভাগ সময় কাটছে তার। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, বিছানায় শুয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। দ্রুত পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাই। বৃদ্ধ না হলে এই কষ্ট বোঝা যাবে না।

রাজধানীর বারিধারার বাসায় গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। জানতে চান দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। রাজনৈতিক দলগুলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, এখন তো টাকা থাকলেই নেতা হওয়া যায়। নীতি আদর্শ খুব বেশি একটা কাজে আসে না। এমন নানান বিষয়ে কথা বলেন তিনি। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে তাকে আর ছাড়তে চান না। আবার ডাক্তার বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছেন, সে বিষয়টিও মনে করিয়ে দেন। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তারপরেও  সব-সময় হাসিখুশি থাকতে চান বলে জানান তিনি। কারও মন খারাপ দেখলে তিনি অখুশি হন। বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় অস ুশিক্ত চোখে আবারও তিনি বলেন, বিছানায় শুয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। বারিধারার বাসায় একমাত্র কন্যা এবং স্ত্রী আমিনা আহমদ এমপিকে নিয়ে থাকেন তিনি। তার স্ত্রী আমিনা আহমদ তার হাতে গড়া রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপের) হাল ধরেছেন।  ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিলা জেলার দেবিদ্বার থানার এলাহাবাদ গ্রামে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জন্ম। তার পিতা স্কুলশিক্ষক আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূঞা, মাতা আফজারুন্নেছা। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ হোসেনতলা স্কুল, জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশন, দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি নেন এবং পরে ইউনেস্কোর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। বিভিন্ন সরকারি কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন তিনি। রাজনীতিতে পদার্পণ  ১৯৩৭ সালে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। চাকরি ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে দেবিদ্বার আসনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মোজাফফর আহমদ মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে হারিয়ে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনামলে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয় এবং ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তিনি আত্মগোপন অবস্থায় আইয়ুবি শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। তিনি আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৬৯ এ আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি আইয়ুব খান আহূত রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের একজন ছিলেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

 ১৯৮১ সালে ন্যাপ-সিপিবি এবং প্রগতিশীল শক্তির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রাক্কালে কারারুদ্ধ হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, ভারত, দক্ষিণ ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ সফর করেন। অধ্যাপক মোজাফফর সমাজতন্ত্র কি এবং কেন, প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা, মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রসহ বেশ কিছু বই ও পুস্তিকা লিখেছেন। ঘটনাবহুল বিশ্বব্যবস্থায় তার রাজনৈতিক দর্শন ও দুরদর্শিতা বাস্তবানুগ ও সময়োপযোগী বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বর্তমানে তার অভিমত, নতুন শতাব্দীতে নতুন সভ্যতা জন্ম নিচ্ছে। তিনি দেশপ্রেমিক কর্মী সৃষ্টির জন্য মদনপুরে উপমহাদেশের একমাত্র শিক্ষায়তন ‘সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সর্বশেষ খবর