শিরোনাম
বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুর্নীতি দূর করতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

সম্মেলনে ডিসিদের বিভিন্ন দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি দূর করতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদেরকে করাপশন (দুর্নীতি) দূর করতে হবে। কারণ কোনো কাজ করতে গেলে সেখানে যদি করাপশন হয়, তাহলে আমার উন্নয়নের ছোঁয়াটা গ্রামবাংলায় বা কোথাও লাগবে না। কাজেই এ ব্যাপারে ডিসিদের (জেলা প্রশাসক) জনসচেতনতাও সৃষ্টি করতে হবে এবং কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। একই সঙ্গে  প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের প্রতি ২৩টি নির্দেশনা দিয়েছেন। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। সম্মেলনে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বক্তব্য  রাখেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কয়েকজন বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বক্তৃতা করেন। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের ভাগ্য গড়ার জন্য কাজ করবে— এটাই যেন সবার লক্ষ্য হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, ‘করাপশন আমার বাংলার কৃষক করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ; যারা তাদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া শিখেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশকে ডিজিটালাইজ করতে তার সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ফলে দুর্নীতিও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এখন আর টেন্ডারের বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা খুব বেশি শোনা যাচ্ছে না। ডিজিটালাইজ করার ক্ষেত্রে কয়েকটা মন্ত্রণালয় এখনো একটু পিছিয়ে আছে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ডিজিটালাইজ করে দেওয়ার ফলে এখন অনেকটা স্বচ্ছতা চলে এসেছে। কাজেই এটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকারি কাজের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করে সরকারি সেবা প্রদান সহজ করতে তার দফতরের অধীনে ‘গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট’ চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, তার সরকারের মূল লক্ষ্য তৃণমূল পর্যায় থেকে উন্নয়ন করা। দেশের একটা মানুষও গৃহহীন থাকবে না। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা তার সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার জন্য ২৩টি নির্দেশনা দেন ডিসিদের উদ্দেশে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। মানুষ যেন শহরমুখী না হয়; শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ যাতে না বাড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্রতী হতে হবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে উন্নয়ন কর্মসূচি এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে, যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ উপকৃত হয়। বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, প্রামের মুরব্বি, নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী, নারী সংগঠক, আনসার-ভিডিপি, গ্রামপুলিশ, এনজিও কর্মীসহ সমাজের সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে। শিক্ষার সর্বস্তরে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় আরও সচেষ্ট হতে হবে। কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনাকে জনপ্রিয় করতে উদ্যোগী হতে হবে। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করে এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডিজির সফল বাস্তবায়নে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করা এবং পেশিশক্তি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাস নির্মূল করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভোক্তা অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির যে কোনো অপচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। নারী উন্নয়ন নীতি সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

মুক্ত আলোচনায় : জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের প্রথম দিনের উদ্বোধন শেষে মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরে বক্তব্য রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কবরী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে মুক্ত আলোচনায় বেশ কয়েকজন বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বক্তব্য রাখেন। একাধিক কমিশনার ও ডিসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষ থেকে তাদের গ্রেড-১ করার দাবি জানানো হয়েছে। আর জেলা প্রশাসকরা তাদের গ্রেড উন্নীত করে ৩ করার দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকরা কাজের ক্ষেত্রে তাদেরকে ঝুঁকি ভাতা দেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেছেন, তাদেরকে অনেক কাজ করতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। যার জন্য তাদের কোনো ঝুঁকি ভাতা দেওয়া হয় না। এই ঝুঁকি ভাতা দেওয়ার জন্য ডিসিরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই তিন দাবি ছাড়াও বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের পক্ষ থেকে আরও কিছু দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে ডিসি সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় গতকাল বিকাল সাড়ে চারটায় সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে। এই অধিবেশনের প্রথমেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সচিবরা ডিসিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সংবাদিকদের বলেন, ‘টিআর-কাবিখা ও জিআর বরাদ্দের জন্য যেসব প্রকল্প পাঠানো হয়, সেগুলোর অস্তিত্ব আছে কিনা, সঠিকভাবে করা হয়েছে কিনা, তা যাচাই করে পাঠাতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বরাদ্দের পর প্রকল্প বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তাও দেখতে বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত উপদেষ্টা  প্রধানমন্ত্রীর তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ডিসিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে গ্রামে বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকবে না। তা ঠিক হতে এক বছরের মতো সময় লাগবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বিষয় সম্পর্কিত কার্য-অধিবেশন শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে শিশু শ্রমমুক্ত করতে চায় সরকার। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের তালিকা করতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত অধিবেশন শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ডিসিদের উদ্দেশে বলেছি জনগণকে বোঝাতে হবে যে, বেশি করে রাজস্ব দিলে সরকারি সেবাও মিলবে বেশি। এজন্য জনসাধারণকে বেশি করে রাজস্ব প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে ডিসিদের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও গতকাল রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ, তথ্য, সংস্কৃতি এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ খবর